বিয়ে হয়েছে প্রায় দেড় বছর। তবে এখনও নিজেকে বিবাহিত মনে করতে কেমন অদ্ভুত লাগে। মনে হয় আমি এখনও বাচ্চা মেয়ে। আমি কারো বউ বা আমাকে কেউ ভাবী ভাবী ডাকে এটা এখনও মানতে পারি না। আমার সমস্যার শুরু আমার সন্তান মারা যাওয়ার পর থেকে। বিয়ের এক বছরের মাথায় আমার সন্তান আসে, কিন্তু পেটে থাকতেই হঠাৎ করে প্রি ম্যাচিউর হয়ে মারা যায়। এর জন্য আমি সবার প্রথমে নিজেকে মাফ করতে পারি না। এমনটা হওয়ার কারণ আমার অতিরিক্ত জার্নি করা। আর এমন গুরুত্বপূর্ণ সময়ে (গর্ভধারণের) আমি ঠিকই ঝুঁকি নিয়ে বাবা মার খুশির জন্য বিয়ের রিসিপশান করলাম। আবার বরের সাথে সম্পর্ক যেন খারাপের দিকে না যায় সেজন্য বিয়ের দিনের ঝামেলা শেষ করে তার সাথে ঢাকার বাহিরে ঘুরতেও গেলাম। এই এতো জার্নি আমার সন্তান নিতে পারলনা।
এরপর থেকেই আমার আর আমার বরের সম্পর্কটাও কেমন যেন হয়ে গেছে। যখনই এই বিষয়ে কথা কাটাকাটি হয় মন চায় মরে যাই! দুইজন একসাথে গেলেই ভালো হইত। আমি কেন যেন অন্যের সন্তান খুব আদর করি কিন্তু এখন আর দেখতে পারি না। মনে মনে মন চায় গলা টিপে ধরি। আমার দুই বড় ভাবীও প্র্যাগনেন্ট। তাদের বাচ্চা হওয়ার সময় সবাই আশা করে আমি তাদের কষ্টে তাদেরকে সাহায্য করব। কিন্তু কেউ এটা বোঝে না আমার সন্তান মারা গেলো ২ মাসও হলোনা, এই সময় আরেকজন প্র্যাগনেন্ট মহিলাকে আমার চোখের সামনে দেখাটা কেমন কষ্টকর! আমি এখন ভাবীর বাচ্চাদেরও মনে মনে দেখতে পারি না। কেমন যেন লাগে। খুব রাগ লাগে আমার। কেন জানি খুব জিদ লাগে। আমার বরও বলে নিজের কষ্ট বলে আরেকজনের কষ্ট বুঝবা না, তার মা ভাবীর কষ্ট হচ্ছে আজকে তাদের যদি কিছু হয় সে আমাকে মাফ করতে পারবে না। এগুলো শুনে আমার হাসিই পায়। সন্তানকে একটা মা যেভাবে অনুভব করে সেটা আসলে অন্য কাউকে বোঝানো সম্ভব না। জানিনা আমাদের দুইজনের সম্পর্ক কীভাবে আগের মত হবে। আমি খুব চাই আমাদের সম্পর্ক আগের মত হয়ে যাক, কিন্তু সবসময়ই আমার শ্বশুরবাড়ির জন্য আমাদের মধ্যে ঝামেলা লেগেই থাকে।
আমার সন্তান মারা যাওয়ার পর আমার আর আমার বরের মাঝে যে দূরত্বের সৃষ্টি হয়েছে তার জন্য আমি আসলে কি করতে পারি? আমি এটা নিয়ে মানসিক অশান্তিতে থাকি বলে পড়াশোনার মনোযোগ দিতে পারছি না এবং আমি অন্যের শিশু সন্তান সহ্য করতে পারছি না।
আমাদের পরামর্শ
আপনার কষ্টের কথা খুলে বলার জন্য আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ। আপনার লেখা অনেক প্রাঞ্জল। সন্তান ধারণের অনুভূতি যেমন স্বর্গীয় তেমনি কোনো কারণে সেই অনুভূতিতে আঘাত লাগলে তা সহ্য করাও অনেক বেশি কঠিন। আর মনের এই অবস্থায় স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কই শুধু নয় মানুষের নিজের সাথে নিজের যে সম্পর্ক তাতেও ভাঙ্গন তৈরি হয়। সন্তান হারানোর মতো এই অপ্রত্যাশিত ঘটনাটি আপনার মনে গভীর ক্ষত তৈরি করেছে। এই ব্যথা থেকেই প্রতিনিয়ত নিজেকে দোষারোপ করছেন। কারণ এটা শুধুমাত্র সন্তান নয়, এর সাথে অনেক আশা ও স্বপ্ন জড়িত ছিল। আর তাই অন্যকারো সন্তানকে বা কারো গর্ভ ধারণের বিষয় সহ্য করতে পারছেন না। অন্যদিকে আপনার বরও তার মনের ক্ষত নিয়ে যুদ্ধ করছে। দৃশ্যটা দেখুন, দুইজন মানুষ নিজের মনের কষ্ট নিয়ে পাশাপাশি আছে কিন্তু কেউ কাউকে শুনতে বা বুঝতে এগিয়ে আসছে না। এ অবস্থায় দূরত্ব তৈরি হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক। তবে সবচেয়ে যেটা আশার কথা, আপনি আপনার ভেতরের কষ্টটা অনেকটাই ধরতে পারছেন, এর ফলে নিজের ভেতরে যে প্রতিক্রিয়া হচ্ছে তাও খেয়াল করছেন এবং তাকে মোকাবেলা করার জন্য উদ্যোগ নিয়েছেন।
সবার আগে নিজের সাথে কথা বলতে হবে। নিজেকে বোঝানোর আগে নিজের মনের কষ্ট আর ব্যথাকে মনোযোগ দিয়ে শুনতে হবে। তখন যে কথাগুলো মন বলবে, খুবই ভাল হয় যদি তা লিখে ফেলতে পারেন। কারণ তখন সন্তান হারানোর ব্যথা আপনার কাছে আরো স্পষ্ট ও দৃশ্যমান হবে। ব্যথা যত স্পষ্ট আর দৃশ্যমান হবে, তত আপনি এই আঘাত সারাতে পদক্ষেপ নিতে পারবেন। আপনার বরের সাথেও মন খুলে কথা বলুন। উনিও এই অপ্রত্যাশিত ঘটনা থেকে কষ্ট পেয়েছেন। তার কষ্টটাও শুনুন, একইভাবে আপনার যন্ত্রণাও তার সাথে ভাগাভাগি করুন। প্রকৃতপক্ষে দূরে সরে গিয়ে নয় বরং কাছে এসেই আমরা একে অপরকে এই কষ্ট মোকাবেলায় শক্তি যোগাতে পারি। আপনার বরের সাথে এ বিষয়ে কথা বলার জন্য আপনাকে এগিয়ে আসতে হবে। তবে তার আগে আপনার নিজেকে মানসিকভাবে তৈরি করতে হবে।
অন্যদের প্রাপ্তি অর্থাৎ সন্তান ধারণ বা সন্তান জন্মলাভ যেমন অনেক বেশি গুরুত্ব দিয়ে দেখছেন তেমনি আপনার আশেপাশে এমন অনেকেই আছেন যাদের আপনার মত বা এরচেয়ে বেশি কঠিন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছিলো। সেইগুলোও গুরুত্ব দিয়ে দেখার চেষ্টা করুন। আপনার মানসিক অবস্থা ভাবীকে বুঝিয়ে বলুন। আমরা অনেক সময় এটা মনে করে কষ্ট পাই যে অন্যরা আমার সমস্যা বুঝতে পারবে। মনে মনে ভাবি, “তাদের তো এটা বোঝার কথা।” কিন্তু বাস্তবতা হল আমি যদি নিজের কষ্ট কাউকে সঠিকভাবে বুঝিয়ে না বলি, তো কারো পক্ষে আমার মত করে আমার অবস্থা বুঝা সম্ভব নয়।
আমাদের কষ্ট আর আনন্দগুলো আকাশে মেঘের মত। কোনটিই স্থায়ী নয়। শুধু সরে যেতে কখনো কম বা বেশি সময় নেয়। আজকের এই আপনি একদিন সন্তানের মা হয়ে যখন সন্তান লালনপালন করবেন, তখন দেখবেন ভিন্ন কষ্ট আর ভিন্ন আনন্দ আপনার আশেপাশে। আজকের এই কষ্টটা তখন একটা অভিজ্ঞতা হয়ে আপনাকে নতুন কষ্ট মোকাবেলার প্রেরণা যোগাবে। জানেনতো জীবনটা একেবারেই মসৃণ নয় । উঁচুনিচু পথ পাড়ি দিয়ে চলাই জীবন। আর এই অমসৃণ চলার পথে আপনি যেন নিজেকে নিজে সহযোগিতা করতে পারেন সেই প্রত্যাশা ও দোয়া রইল।
শাম্মী আকতার
এসিস্ট্যান্ট কাউন্সেলিং সাইকোলজিস্ট