Secure attachment

বাবা মারা যাওয়ার পর আমি খুবই বিব্রতকর মানসিক অবস্থায় আছি

আমার বয়স ১৯ বছর। আমি ২০০২ সাল থেকে মানে দুই বছর বয়স থেকে বাবার সাথে ঘুমাই। গত জুলাই মাসে বাবা মারা যায়। তারপর বিছানা আলাদা হয়ে যায়। এখানে উল্লেখ্য বাবা মায়ের সাথে সম্পর্ক ছিল ইতিবাচক। বাবার সাথে আমার অনেক ভাল সম্পর্ক ছিল। আমি আমার সমবয়সীদের চেয়ে বাবার সাথেই বেশি থাকতাম। বাবাও আমাকে ভালবাসতেন। কিন্তু বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে আমি একটা খুবই বিব্রতকর মানসিক অবস্থায় ভুগছি। সারাক্ষণ আমার মনে হয় আমার বাবার জায়গায় যদি আমার মা মারা যেত, তাহলে তো আমার বাবার বাড়ির লোকেরা আমার বাবাকে ধরে বেঁধে বিয়ে দিয়ে দিত। তখন সৎ মায়ের জ্বালায় আমার জীবন অতিষ্ঠ হয়ে যাইত। এগুলো মনে করেই আমার তখন আমার মাকে সৎ মা মনে হয়। আমার এখন বাবার বাড়ির লোকদের সহ্য হয় নাহ। মনে হয় এরাই তো আমার বাবাকে বিয়ে দিয়ে আমার জীবন নরক বানিয়ে দিত। 

এখানে এবার আমি আমার সম্পর্কে কিছু তথ্য দিচ্ছি। আমি দেখতে ফর্সা ও লম্বা। একাডেমীক ফলাফল বরাবরই ভাল। ব্যবহার মার্জিত। বন্ধুসুলভ কিন্তু গার্লফ্রেন্ড ছিল না। তবে বাবার বাড়ির লোকেরা বাবার উপর আর্থিকভাবে নির্ভরশীল ছিল। এটা নিয়ে আমি আর আমার মা বিরক্ত ছিলাম। এছাড়াও আমার বাবার বাড়ির লোকেরা বাবা মারা যাওয়ার পর আর্থিকভাবে সহায়তা করেন নি। যদিও বাবার পেনশন দিয়ে ভালই আছি। এখন মনে হয়, আমার যদি সৎ মা থাকতো আর বাবা যদি সৎ মায়ের নামে সব টাকা দিয়ে যাইত, তাহলে আমার আর আমার বোনের কি হইত? এগুলো ভাবলে পুরো জীবন থমকে যায়। আর আমি তখন মাস্টারবেট করি। আত্মহত্যার ইচ্ছা জাগে। কিচ্ছু বুঝছি না। বাবার জন্য দুঃখের থেকে বেশি এসব চিন্তা করে দুঃখ হয়। শুধু তাই না, বাসায় থাকলে চিন্তা হয়,”যদি বাসে উঠে দেখি টাকা নেই নাই, তাহলে বাসের হেলপার আমাকে মারবে না তো?” ” নতুন জায়গায় গেলে আমাকে কেউ ঠকাবে না তো?” “কিভাবে এপ্রোচ করব তাও জানি নাহ?” তবে আমি গুছিয়ে সুন্দরভাবে কথা বলতে পারি। সারাদিন চিন্তা করি ফ্রিল্যান্সিং করে কোটিপতি হয়ে যাবো। কিন্তু এসব নিয়ে চিন্তা আমার কাজকর্ম, নামাজ-কালাম, পড়াশুনা, শরীরচর্চায় প্রভাব ফেলছে। এখন কি করা যায়?

আমাদের পরামর্শ

আপনাকে ধন্যবাদ প্রশ্নটি করার জন্য। আপনার কথা থেকে বোঝা যাচ্ছে বাবা মারা যাওয়ার পর বেশ কিছু বিষয় নিয়ে আপনার মাঝে ভয় কাজ করছে, অনেক বিষয় নিয়ে নেতিবাচক চিন্তা হচ্ছে এবং সেই চিন্তা আপনার দৈনন্দিন স্বাভাবিক কর্মকাণ্ডে প্রভাব ফেলছে।

 

প্রথমত, আপনার লেখা থেকে বোঝা যাচ্ছে বাবার সাথে আপনার বেশ ভালো বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। বাবাও আপনাকে ভালো বুঝতে পারতো, যার ফলে আপনি ছোটবেলা থেকেই বাবার সাথে ঘুমোতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। সমবয়সী বন্ধুদের থেকেও বাবার সাথেই বেশি সময় কাটাতেন। অর্থাৎ বাবাই ছিল আপনার প্রধান এবং অন্যতম মানসিক আশ্রয়ের স্থল। অন্যভাবে বললে বাবার সাথে একটি দৃঢ় মানসিক বন্ধনে আবদ্ধ ছিলেন। হঠাৎ করেই জীবনের সবচেয়ে আশ্রয়ের মানুষটি আপনার কাছ থেকে হারিয়ে গেল। এই ভালবাসার মানুষকে হারানো আপনার জন্য কতটা কষ্টের, কতটা গভীর ক্ষত আপনার মনে পড়েছে, সেটা আমি ভাবতেই পারছি না। 

 

আপনি বলেছেন বাবা ছাড়া সেরকম কোন বন্ধুর সাথে মিশতেন না, আপনার মেয়েবন্ধুও নেই। ফলে বাবাকে হারানোর পর আপনার মধ্যে যে শূন্যতা তৈরি হয়েছে, তা আপনি কোনভাবেই পূরণ করতে পারছেন না। মায়ের সাথে আপনার সম্পর্ক আগে থেকে কেমন ছিল, এখনইবা কেমন, সে সম্পর্কে কিছু বলেন নি। মা-কে বাবার জায়গায় সম্পূর্ণভাবে প্রতিস্থাপন করা হয়ত সম্ভব না, কিন্তু একটু উদ্যোগ নিয়ে দেখতে পারেন। বাবার সাথে সময় কাটিয়ে যেরকম মানসিক ভরসা পেতেন, মা’র সাথেও কিছুটা আশ্বস্ত হতে পারেন কি না। 

 

আপনার অন্যতম মানসিক নিরাপত্তার জায়গা মানে আপনার বাবা হারিয়ে যাওয়ার ফলে আপনি যে মানসিক নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন তার কিছু উদাহরণ আপনি দিয়েছেন। যেমন, “বোনের ভবিষ্যৎ কী হবে?”,  “যদি বাসে উঠে দেখি টাকা নেই নাই, তাহলে বাসের হেলপার আমাকে মারবে না তো?” “নতুন জায়গায় গেলে আমাকে কেউ ঠকাবে না তো?” “কিভাবে এপ্রোচ করব তাও জানি নাহ?” ইত্যাদি ইত্যাদি। এছাড়াও একটি সম্পূর্ণ ভ্রান্ত চিন্তায় আপনি বিভোর আছেন, মা মারা গেলে বাবা আরেকবার বিয়ে করত। সেই সৎ মা এসে আপনাকে কষ্ট দিত। অথচ এরকমটা হওয়ার কোনো সম্ভাবনায় এখন আর নেই। এসব কিছু থেকে একটা বিষয় বোঝা যাচ্ছে, বাবার সাথে আপনার বন্ধন ছিল অনেক গভীর এবং এখন যে আর বাবা নেই সেই সত্যটি হয়ত আপনি মানসিকভাবে মেনে নিতে পারেন নি।

 

নিরিবিলি কোনো স্থানে বসুন, শ্বাসপ্রশ্বাসের দিকে মনোযোগ দিন । বাবার স্মৃতি মনে করুণ। এরপর ধীরে ধীরে সচেতন মনকে আপনার শ্বাসপ্রশ্বাসের দিকে নিয়ে আসুন। খেয়াল করুণ, বাবা হারানোর কষ্ট শরীরের ঠিক কোথায় অনুভব করছেন-বুকে, কাঁধে, পেটে না মাথায় নাকি শরীরের অন্যকোনো অংশে। এরপর ধীরে ধীরে স্বীকার করুণ বাবা আর নেই। আপনার যদি অনেক কান্না পায়, তাহলে কাঁদুন। যদি মনের কষ্টগুলো লিখতে পারেন তাহলে আরো ভালো হয়। এভাবে কয়েকবার কয়েকদিন এই চর্চা করুণ। ভালো বোধ করবেন। 

 

প্রয়োজনে একজন পেশাদার মনোবিজ্ঞানী যেমন কাউন্সেলিং, এডুকেশনাল বা ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্টের কাছে গিয়ে কাউন্সেলিং সেবা নিতে পারেন। আপনার পড়ালেখা, আচার ব্যবহার, বাহ্যিক চেহেরা, সামাজিক দক্ষতা অনেক প্রশংসার দাবি রাখে। শুধু এখন নিজেকে একটু শক্ত হয়ে দাঁড়াতে হবে। শৈশব, কৈশোর পেড়িয়ে গেছে, আপনি এখন যৌবনে প্রবেশ করেছেন। মায়ার বন্ধনগুলোকে শক্তি হিসেবে ব্যবহার করতে হবে, প্রতিবন্ধকতা হিসেবে নয়। তবেই আপনি আত্মশক্তি ফিরে পাবেন। আপনার জন্য শুভকামনা। 

মাহিউদ্দিন মাহি
মহিউদ্দিন মাহি
+ posts

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মনোবিজ্ঞানে স্নাতক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কাউন্সেলিং মনোবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর করার পর এখন এসিস্ট্যান্ট কাউন্সেলিং সাইকোলজিস্ট হিসেবে কাজ করছি।

Post Author: মহিউদ্দিন মাহি

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মনোবিজ্ঞানে স্নাতক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কাউন্সেলিং মনোবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর করার পর এখন এসিস্ট্যান্ট কাউন্সেলিং সাইকোলজিস্ট হিসেবে কাজ করছি।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।