মনের গতিপ্রকৃতি

মনের গতিপ্রকৃতি-খুঁজে বেড়াই নিজেকে

মনের গতিপ্রকৃতি বোঝা বড় মুশকিল! আমরা অনেক সময়ই খুব দ্বিধান্বিত হয়ে পড়ি, কোন কাজটা করা ঠিক হবে আর কোনটা ভুল। এর সাথে আছে, লোকে কী ভাবছে, তার চিন্তা। দেখা গেল সকালে উঠে যখন নিজেকে তৈরি করছি, তখন ভাবছি ‘অন্যজনের কাছে  আমাকে কেমন লাগবে?’ ‘উমুক আমাকে দেখলে কি বলবে? সাজটা কেমন হলে সবাই গ্রহণ করে নেবে’। আবার ধরেন, আপনি হয়ত গাঢ় রংয়ের কোন ড্রেস পড়েছেন, এক বন্ধু বলে বসল, ‘তোকে যেন কেমন ক্ষেত ক্ষেত লাগছে!’ অন্যদিকে হালকা কোন রং পরেন, আরেকজন হয়ত বলবে ‘তোমার কি পছন্দ বলতে কিছু নেই?’

 

অর্থাৎ কী পড়ব, আর কি পড়ব না, তা নিয়ে সংশয়! এরকম উদাহরণ আরো আছে। ‘পরীক্ষায় খারাপ করলে সবাই কি বলবে’ এই চিন্তা করে করে নিজের উদ্বিগ্নতা বাড়িয়ে অনেক মেধাবী ছাত্রছাত্রীকেও স্বাভাবিকের চেয়ে খারাপ ফলাফল করতে দেখা যায়। কখনও কি ভেবেছেন মনের মধ্যে এত দ্বিধা বা দ্বন্দ্ব-কী করব, কী করব না, অন্যেরা কী ভাববে, ইত্যাদি ইত্যাদি, কেন আসে? কোথা থেকে আসে? দিনের পর দিন এরকম চিন্তা কী আপনার কোন উপকারে আসছে? এসব দ্বিধা-দ্বন্দের অনেক কারণ আছে। তবে কারণ যাইহোক, এগুলো আপনার মোটেই উপকার করছে না। আমার মধ্যে দীর্ঘদিন এরকম চিন্তা বসবাস করলে, হয়তবা একদিন আমি ‘আমার আমি’-কেই খুঁজে পাব না, হারিয়ে যাব অন্যদের মাঝে।

আপনি প্রাণপণ চেষ্টা করছেন, অন্যকে খুশি করতে, অন্যের চোখে ভালো হতে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে পারেন না। ফলে আপনার খারাপ লাগা আরো বেড়ে যায়। নিজের প্রতি বিশ্বাস কমে যায়। অনেককেই বলতে শোনা যায় ‘আমার কাছেও তো ব্যাপারটা কেমন জানি লাগছে, কারণ সবাই তো তাই বলে’।

মনোবিজ্ঞানী কার্ল রজার্সের মতে আমাদের প্রত্যেকেরই দুইটা সত্তা আছে। একটা হল আমি আসলেই যা (তার মতে Real Self), আরেকটা হল অন্যদের চোখে আমি যা বা যেমন হতে চাই (তার মতে Ideal Self)।

দ্বিতীয় সত্তা নিয়েই আমাদের দিনরাত গড়িয়ে যায়। এটা যেমন সঠিক যে দুইটা সত্তা নিয়েই আমরা, কোনটা বাদ দিয়ে জীবন হবে না, তেমনি এই দুইয়ের মধ্যে পার্থক্যটা যদি খুব বেশি হয়, তবে দেখা দিতে নানা অসুবিধা। যেমন, আপনার হয়ত ইচ্ছে করছে, জোরে জোরে বাংলা সিনেমার গান গাইতে। কিন্তু আপনি তা করছেন না। কারণ, লোকে আপনাকে ক্ষেত বলবে। সুতরাং লোকের চোখে ভালো থাকার জন্য আপনি বাংলা সিনেমার গান গাওয়া থেকে বিরত থাকলেন। এখানে, গান গাইতে চাওয়াটা হলো আপনার আসল সত্তা, আর গান না গেয়ে ভদ্র থাকাটা হলো, আইডিয়েল সত্তা। এই দুই সত্তার মধ্যে যত ফারাক হবে, ততই মানসিক অস্থিরতা বা অস্বাভাবিকতা দেখা দিবে। একবার ভেবে বলুনতো, সারাদিনে আপনি যা কিছু করেন, তার কতগুলো আসে আপনার আসল সত্তা থেকে আর কতগুলো আসে সমাজ আরোপিত সত্তা থেকে?

মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, একটু একটু করে দুইটি সত্তার দূরত্ব কমাতে আমার নিজের চাওয়া আর অন্যদের চাওয়ার মাঝে যোগসূত্র তৈরি করতে হয়। এটি অনেকটাই এসার্টিভ কমিউনিকেশনের মত-অন্যরা আমার কাছে যা চাইছে সেটিকে ছোট না করে, নিজের চাওয়াটাও করে দেখানো। যেমন, আমি আমার পছন্দ মত একটা ড্রেস পরলে যদি কেউ নেতিবাচক মন্তব্য করে তাহলে বলতে পারি বা মনেমনে ভাবতে পারি, ‘হ্যাঁ তোমার কাছে রংটা মনে হয় পছন্দ হয়নি কিন্তু আমার কাছে এটি খুব ভাল লেগেছে’। আবার ফলাফল খারাপ হলে যদি শুনতে হয় ‘পড়াশুনা না করলে তো এসব ফলাফল হবেই, এত কষ্ট করে বাবা-মা পড়াশুনা করাচ্ছে তার পড়েও এই রেজাল্ট!’ তখন হয়ত উত্তর দিতেও পারি বা মনেমনে ভাবতে পারি, ‘এটা ঠিক যে এবার আমার ফলাফলটা খারাপ হয়েছে, কিন্তু এর মানে এই নয় যে আমি মনোযোগী নই, আমি চেষ্টা করতেই পারি এবং সেই চেষ্টাই করছি। তার মানে আমি বাবা-মায়ের কষ্টটাকেও ছোট করে দেখি না’।

নিজের মনের গতিপ্রকৃতি বুঝতে নিজের সাথে কথা বলতে হবে। আর চিন্তার ধরনেও পরিবর্তন আনলে সিদ্ধান্ত নেয়ার দ্বন্দ্ব কমে আসবে। নিজের প্রত্যাশা আর অন্যজনের জন্য নিজের কাছে প্রত্যাশা, এই দু’টোকে এক না করে আলাদা করে খুঁজে দেখি। হয়ত নিজেকে আরো ভাল করেই খুঁজে পেতে পারি।

Shammi Akter
শাম্মী আকতার
+ posts

এসিস্ট্যান্ট কাউন্সেলিং সাইকোলজিস্ট

Post Author: শাম্মী আকতার

এসিস্ট্যান্ট কাউন্সেলিং সাইকোলজিস্ট

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।