বুদ্ধি বনাম আবেগীয় বুদ্ধি

সফলতার আদ্যোপান্ত (পর্ব-১): বুদ্ধি বনাম আবেগীয় বুদ্ধি

আবেগীয় বুদ্ধি, ইংরেজিতে বলা হয় Emotional Intelligence। পৃথিবীব্যাপী এখন বুদ্ধির চেয়ে আবেগীয় বুদ্ধিই বেশি সমাদৃত। বলা হচ্ছে মানুষের ব্যক্তিগত এবং পেশাগত জীবনে সফলতার পেছনে রয়েছে এই আবেগীয় বুদ্ধিরই লীলাখেলা। মনোবিজ্ঞানের বিভিন্ন গবেষণাও কিন্তু তাই বলছে।

বুদ্ধি কী তা আমরা কমবেশি সবাই জানি। জন্মগতভাবে আমাদের বেশিরভাগ মানুষেরই স্বাভাবিক মাত্রার বুদ্ধি থাকে। সেই অর্থে আমরা বেশিরভাগ মানুষই বুদ্ধিমান। এই স্বাভাবিক মাত্রার নিচে বুদ্ধি হলে তা হয়  বুদ্ধি প্রতিবন্ধকতা, আর এই মাত্রার উপরে যাদের বুদ্ধি তাদেরকে বলা যায় তুখোড় বা অতি বুদ্ধিমান। তবে স্বাভাবিক সীমার নিচে বা উপরে বুদ্ধি থাকা মানুষগুলোর সংখ্যা খুব অল্প।

তাহলে দাঁড়াচ্ছে, ব্যক্তিগত এবং পেশাগত জীবনে সফল ও সুখী মানুষগুলোর সবাই তুখোড় বা অতি বুদ্ধিমান নয়। আবার তুখোড় বা স্বাভাবিক মাত্রার উপরে যাদের বুদ্ধি তারাও যে সবাই সফল এবং সুখী তাও নয়। তাহলে সুখ ও সফলতার পেছনের রহস্য কি? কেনইবা একই মাত্রার বুদ্ধি ও চেষ্টা থাকা সত্ত্বেও কেউ সফল আবার কেউ ব্যর্থ হয়? এই প্রশ্ন দুটির উত্তরের মাঝেই রয়েছে আবেগীয় বুদ্ধির শক্তপোক্ত স্থান। হ্যা, আপনি বলতেই পারেন, ভাগ্য বলেও তো একটা ব্যাপার আছে। সেক্ষেত্রে বলব, আবেগীয়ভাবে বুদ্ধিমান ব্যক্তিরা ভাগ্যেরও গতিপথ বদলে ফেলতে পারে!   

গনিত কিংবা বিজ্ঞানের অনেক সূত্রই তো আমাদের জানা আছে। এবার জেনে নেয়া যাক সফলতার সূত্রটি, যার মাধ্যমে বদলানো যায় ভাগ্যেরও গতিপথ!     

সফলতা হচ্ছে আপনার  বুদ্ধি বা ক্ষমতা থেকে বাঁধা বিয়োগ করলে যা থাকে, তাই।    

অর্থাৎ আপনার বুদ্ধি বা ক্ষমতার ফলে যে সফলতা পাবার কথা, বিভিন্ন বাঁধার কারণে আপনি তা অর্জন করতে ব্যর্থ হচ্ছেন। বাঁধা হতে পারে অভ্যন্তরীণ। অর্থাৎ আপনার নিজের কোনো সীমাবদ্ধতা, যেমন, দক্ষতার ঘাটতি, অহেতুক ভীতি ইত্যাদি। তেমনিভাবে, বাঁধা হতে পারে বহিরাগত কিছু। আর এই বাঁধা অতিক্রম করার জন্যই প্রয়োজন আবেগীয় বুদ্ধি।     

আবেগীয় বুদ্ধি কী?

খুব ছোট্ট করে বললে, আবেগীয় বুদ্ধি হলো, ‘নিজেকে ও অন্যদেরকে বুঝতে পারা এবং সেইসাথে নিজের ও অন্যদের সাথে অর্থপূর্ন সংযোগ স্থাপন করতে পারা’।  

নিজের সাথে সংযোগ স্থাপন করেই আপনি আপনার ভেতরের বা অভ্যন্তরীণ বাঁধাগুলোকে অতিক্রম করতে পারেন। আর নিজের সাথে সংযোগ স্থাপন তখনই সম্ভব যখন আপনি নিজের আবেগ-অনুভূতিগুলোকে বুঝতে পারবেন এবং সেগুলোর ব্যবস্থাপনা করে যথাযথ আচরণ করতে পারবেন। ঠিক তেমনি অন্যদের সাথে সংযোগ স্থাপনের মাধ্যমে আপনি বাইরের বাঁধাগুলোকে অতিক্রম করতে পারেন। আর এই সংযোগ স্থাপনের জন্য প্রয়োজন অন্যদের আবেগ-অনুভূতিগুলোকে বোঝা এবং সেই অনুযায়ী যথাযথ আচরণ করা। আসলে এই ব্যাপারগুলো পরস্পর নির্ভরশীল। যেমন,  নিজের আবেগ-অনূভুতিকে বুঝতে না পারলে অন্যের আবেগ-অনুভূতিকে বোঝা সম্ভব নয়। ঠিক তেমনি নিজের ভেতর থেকে আসা বাধাগুলোকে অতিক্রম করতে না পারলে বহিরাগত বাধাগুলোকেও অতিক্রম করা যায় না। সেই গ্রামীণ প্রবাদটির মত, ‘বনের বাঘ নয়, মনের বাঘই খায়’।

উপরের সংজ্ঞা অনুযায়ী আবেগীয় বুদ্ধির বৈশিষ্ট্যগুলো হল-  

এক। আত্ম-সচেতনতা (Self awareness)

আবেগীয়ভাবে বুদ্ধিমান ব্যক্তিরা আত্মসচেতন। নিজেদের যোগ্যতা এবং দুর্বলতা উভয় সম্পর্কেই তারা সচেতন। নিজেদের আবেগ-অনুভূতি, চিন্তা-চেতনা এবং আচরণগুলো তারা বুঝতে পারে। অর্থাৎ তাদের মনের বাঘের উপস্থিতি বা গতিপ্রকৃতি তারা ঠিক উপলব্ধি করতে পারে।           

দুই। আত্ম-সঞ্চালনা (Self regulation)

আবেগীয়ভাবে বুদ্ধিমান ব্যক্তিরা নিজেদের আবেগ-অনুভূতি এবং আচরণের ব্যবস্থাপনা জানে। জীবনকে যদি একটি ঘুড়ির সাথে তুলনা করা হয় তাহলে তার নাটাই থাকে তাদের নিজেদেরই হাতে। তারা নিজেই নিজেদেরকে অনুপ্রেরণা যুগিয়ে সামনে এগিয়ে চলে এবং জানে কোথায় থামতে হয়।       

তিন। সমানুভূতি (Empathy)

সমানুভূতি হল আরেকজন মানুষের অনুভূতিগুলোকে ঠিক তার অবস্থান থেকে বুঝতে পারা। যেমন কেউ যদি পরীক্ষায় ফেইল করে মন খারাপ করে বসে থাকে, আর তাকে যদি গিয়ে বলা হয়, ‘আরে এটা কোন ব্যাপার না, মন খারাপ কর না, দেখ তোমার চারপাশে আরো কত দুঃখী মানুষ, সে তুলনায় তুমি কত ভাল অবস্থানে আছো…’ তাহলে সেটা হবে সান্ত্বনা। সান্ত্বনার মাধ্যমে না কাউকে ভাল রাখা যায়, না কারও সাথে আন্তরিক সম্পর্ক স্থাপন করা যায়। কারণ এই ধরনের পরিস্থিতিতে সান্ত্বনা দিলে ভুক্তভোগির মনে হবে আপনি তাকে বুঝতে পারছেন না। তাই সমানুভূতি প্রকাশের জন্য ভাবতে হবে, তার জায়গায় আপনি থাকলে আপনার কেমন লাগত। তারপর তার পাশে থেকে যদি তাকে বলেন, ‘আমি বুঝতে পারছি তোমার মনের অবস্থা, তুমি খুব কষ্ট পাচ্ছো’ সেটাই হবে সমানুভূতি। সমানুভূতি জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রয়োজন। কোন একটি ঘটনা ঘটার পর আমরা যদি বিভিন্ন এঙ্গেল থেকে বা বিভিন্ন জনের অবস্থান থেকে ঘটনাটিকে দেখি তাহলে আমাদের পক্ষে সর্বোৎকৃষ্ট আচরণটি করা সম্ভব হবে।                

চার। সামাজিক দক্ষতা (Social skills)

অন্যদের সাথে যথাযথভাবে সংযোগ স্থাপনের জন্য সমানুভূতির পাশাপাশি সামাজিক দক্ষতা এবং যোগাযোগের দক্ষতাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সামাজিক দক্ষতা আমাদের জীবনকে সহজ ও সমৃদ্ধ করে। আপনার চারপাশে হাজারো মানুষ। কার অবস্থান কোথায় হবে আর কার সাথে কেমন আচরণ বা সম্পর্ক হবে তা আপনাকেই নির্ধারণ করতে হবে। আপনি কাকে সহযোগিতা করবেন এবং কিভাবে করবেন, আর কাকে ‘না’ বলবেন এবং কিভাবে বলবেন সেই দক্ষতা না থাকলে সম্পর্কগুলোকে আপনার কাছে বোঝা মনে হবে। সেইসাথে আপনি কার কাছে সহযোগিতা চাইবেন এবং কিভাবে চাইবেন তাও জানা থাকা দরকার।   

আবেগীয় বুদ্ধির সবচেয়ে বড় সৌন্দর্য হলো এটি বাড়ানো যায়। অর্থাৎ আপনার আবেগীয় বুদ্ধির ঘাটতি থাকলে আপনি তা বাড়াতে পারেন। এই পর্বে সংক্ষেপে আবেগীয় বুদ্ধি এবং এর বৈশিষ্ট্যগুলো জানা হলো। আর কিভাবে এই বৈশিষ্ট্যগুলো অর্জন করে আবেগীয়ভাবে বুদ্ধিমান হবেন, অর্থাৎ আবেগীয় বুদ্ধি বাড়ানোর বিভিন্ন কৌশল থাকছে পরের পর্বগুলোতে। পড়তে থাকুন! (চলবে)

রাউফুন নাহার
+ posts

রাউফুন নাহার মাস্টার্স করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশনাল অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগ থেকে এবং অনার্স করেছেন একই বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগ থেকে। বর্তমানে এডুকেশনাল এন্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগে প্রভাষক হিসেবে কর্মরত আছেন। ভালোবাসেন মানুষ, প্রকৃতি আর তাদের ভেতরের অন্তর্নিহিত সুরকে।

Post Author: রাউফুন নাহার

রাউফুন নাহার মাস্টার্স করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশনাল অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগ থেকে এবং অনার্স করেছেন একই বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগ থেকে। বর্তমানে এডুকেশনাল এন্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগে প্রভাষক হিসেবে কর্মরত আছেন। ভালোবাসেন মানুষ, প্রকৃতি আর তাদের ভেতরের অন্তর্নিহিত সুরকে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।