মনে মনে কথা বলি

অন্য মানুষের তুলনায় একটু বেশিই মনে মনে কথা বলি

আমি দ্বাদশ শ্রেণির বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র। আমার বয়স ১৯ বছর।

  • আমি মানুষের সাথে কথা বলার সময় মাঝে মধ্যে কমফরটেবল ফিল করি না। তখন যেন আমার ভেতরে একটা ছটফট ভাব কাজ করে। কেমন যেন একটা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। যার ফলে কথায় জড়তা এসে যায়, ওলটা পালটা কিছু বলি। আবার ভালো কোনো যুক্তি সম্পন্ন কথা বা হাসির কোনো জোকসও বললে ভেতরে কেমন অস্থিরতা কাজ করে, মনে হয় যেন আমি ভয় পাচ্ছি। আবার কখনও কখনও ঘেমেও যাই, যেটা অনেক বিরক্তিকর লাগে। 
  • এসবের কারণে হয়ত আমি মানুষের সাথে ভালোভাবে মিশতে পারি না। তাদের সাথে কানেক্টেড থাকতে পারি না। মানুষের সাথে ভালো বন্ড (বন্ধন) তৈরি করতে পারি না।
  • আমার মনে হয় যে আমি অন্য মানুষের তুলনায় একটু বেশিই মনে মনে কথা বলি, ভাবি। এটা বেশি বেশি হলে মোটেও ভালো লাগে না। কখনও কখনও আবার মাথা ধরে যায়।
  • প্রতিটা দিন একটু আনন্দঘন যাওয়া উচিত কিন্তু এমন হয় না।

 

১৪ বছর বয়সের আগে আমি এমন ছিলাম না। এর বিপরীত একজন ছিলাম বললে ভুল হবে না। ৫-৬ মাস আগে এ ধরনের সমস্যার কথা মা, বাবা, মামার সাথে শেয়ারও করেছি। কিন্তু তেমন লাভ হয় নি।

আমার প্রশ্ন হলোঃ

১. উপরের সমস্যাগুলো কিভাবে দূর করতে পারি?

২. কোন ধরনের মানুষের সাথে আমি পরামর্শ করতে পারি?

৩. যদি তারা সাইকোলজিস্ট হয় তাহলে ভালো সাইকোলজিস্টদের নাম এবং তারা কোথায় বসেন সেগুলো একটু বলবেন?

৪. কিভাবে আমি কমিউনিকেশন স্কিলে একজন এক্সপার্ট হতে পারি এবং তার জন্য কি করতে পারি, কাদের সাথে যোগাযোগ করতে পারি?

আমাদের পরামর্শ

আপনাকে ধন্যবাদ সুন্দর করে আপনার কথা তুলে ধরার জন্য।

মানুষের সাথে কথা বলার সময় আপনি উদ্বিগ্নতা এবং অস্থিরতা অনুভব করেন, ফলে যা বলতে চান তা গুছিয়ে বলতে পারছেন না। অনেক সময় ভয় কাজ করে এমনকি যখন আপনি কোনো যুক্তিসঙ্গত অথবা মজার কথা বলেন তখনও। সামাজিকভাবে বসবাসের কারণে অন্যরা তাকে কিভাবে দেখছে তা মানুষের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে। সামাজিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে তখন ‘অন্যদের দ্বারা প্রত্যাখান” (Fear of rejection) এবং ‘অন্যের দ্বারা বিচার’ (Fear of judgement) হবার ভয় কাজ করে। এই “Fear of rejection” এবং “Fear of judgement”র কারণে অন্যের সাথে কথা বলার সময় অস্থিরতা বোধ হয়, ভয় লাগে। এ ছাড়াও কথা বলা নিয়ে অতীতের কোনো নেতিবাচক অভিজ্ঞতা, বর্তমানের সমস্যার সাথে জড়িত থাকতে পারে। 

নিজেকে অন্যদের সাথে তুলনা করে ছোট মনে করার কারণেও (যাকে বলা হয় “Inferiority complex”) অন্যের সাথে কথা বলতে জড়তা আসতে পারে।

আপনি বলেছেন আপনার এই অস্থিরতা এবং এর ফলে তৈরি শারীরিক প্রতিক্রিয়ার কারণে মানুষের সাথে মিশতে এবং সম্পর্ক তৈরি করতে পারেন না। যা আপনার জন্য মানসিক অশান্তির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

নিজের সাথে নিজেও অনেক কথা বলেন যা আপনি পছন্দ করছেন না। আমরা সবাই কম বেশি নিজের সাথে কথা বলি, যাকে বলা হয় “Self Talk”। এটা সাধারণত দুই ধরনের হয়, Positive self talk- যেখানে নিজের সাথে কিছু ইতিবাচক কথা হয় এবং Negative self talk- যেখানে নিজের সাথে নেতিবাচক কথপোকথন হয়। আপনি উল্লেখ করেননি নিজের সাথে ঠিক কি ধরনের কথা বলেন। আপনি আপনার ইস্যু নিয়ে মা বাবার সাথে কথা বলেছেন কিন্তু আশানুরূপ ফল পাননি। তবে এ থেকে বুঝা যায়, আপনি আপনার এই ইস্যু নিয়ে কাজ করতে আগ্রহী এবং শেয়ার করার জন্য কিছুটা পদক্ষেপও নিয়েছেন। এই সচেতনতা আপনাকে অসুবিধা থেকে বের হতে সহায়তা করবে বলে আশা করছি।

আপনি আমাদের কাছে কিছু প্রশ্ন করেছেন। সেসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করছি।

[প্রশ্ন ১ঃ উপরের সমস্যাগুলো কিভাবে দূর করতে পারি?]

আপনার ইস্যুটি নিয়ে কথা বলতে সুবিধা হতো যদি আপনি আরো বিস্তারিত উল্লেখ করতেন। যেমনঃ যখন আপনি মানুষের সামনে কথা বলেন তখন ঠিক কি কি চিন্তা হয়? পরবর্তীতে সে চিন্তাগুলো কতক্ষণ স্থায়ী হয়? সবার সাথে কথা বলার সময়ই কী এমনটা হচ্ছে? যাদের সাথে কথা বলতে অস্থিরতা বোধ করছেন তারা আপনার পরিচিত নাকি নতুন কোনো মানুষের সাথে কথা বলতেই বেশি উদ্বিগ্ন বোধ করেন? এমন কিছু মানুষ আছে যাদের সাথেই কেবল কথা বলতে বা মিশতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন?

সামাজিক যোগাযোগের উদ্বিগ্নতা মোকাবেলার কৌশল মানুষভেদে ভিন্ন হয়ে থাকে। সাধারণভাবে দুটি দিকে মনোযোগ দেয়া হয়।  

এক, উদ্বিগ্নতা এবং অস্থিরতার সময় দ্রুত কিভাবে নিজেকে প্রশান্ত করা যায়,

দুই, বিভিন্ন মনোসামাজিক ইন্টারভেনশনের সাহায্যে কিভাবে সামাজিক দক্ষতা বৃদ্ধি করা যায়।  

কারো সাথে কথা বলার সময় অতিরিক্ত উদ্বিগ্ন এবং অস্থিরতা অনুভব করলে নিচের ধাপগুলো অনুসরণ করতে পারেন।

ধাপ এক।

আপনি জানিয়েছেন প্রায় সময় আপনার শরীর ঘেমে যায়। তখন কয়েকবার লম্বা শ্বাসপ্রশ্বাস নিন। এরপর আপনার শারীরিক প্রতিক্রিয়ার দিকে মনোযোগ দিন, যেমন যখন আপনি ঘামছেন আপনার শারীরিক কি কি পরিবর্তন হচ্ছে, খেয়াল করুণ। এতে করে যে চিন্তার কারণে আপনার উদ্বিগ্নতা এবং অস্থিরতার অনুভূতি হয়েছে, তা থেকে নিজের মনোযোগ সরিয়ে আনা সম্ভব হবে। ফলে অস্থিরতা কমে আসবে।

ধাপ দুই।

বিভিন্ন মানুষ বিভিন্ন উপায়ে সামাজিক যোগাযোগ দক্ষতা বৃদ্ধি করেন। যোগাযোগ দক্ষতা বৃদ্ধিতে সহায়ক এমন একটি জনপ্রিয় এবং কার্যকরী কৌশল হল অহিংস যোগাযোগ বা Nonviolent Communication (NVC)। অহিংস যোগাযোগ করতে হলে চারটি উপাদানের বিষয়ে সজাগ থাকতে হবে। NVC’র চারটি উপাদান হল

   ১) পর্যবেক্ষণ (Observation)

   ২) প্রয়োজন/চাহিদা (Need)

   ৩) অনুভূতি (Feeling) এবং

   ৪) অনুরোধ (Request)

উদাহরণ দিয়ে ব্যাখ্যা করছি। একটা ঘটনার কথা চিন্তা করুণ। কলেজে আগামীকাল সকালের ক্লাস বাতিল হয়েছে এবং আপনার বন্ধু জেনেও আপনাকে জানায় নি। আপনার মেজাজ খুব খারাপ। আপনি তাকে খারাপভাবে বকাবকি করতে পারেন অথবা মনে মনে কষ্ট পেয়ে চুপসে থাকতে পারেন। যেভাবেই আপনার ক্ষোভ প্রকাশ করেন না কেন, সেটা সহিংস হয়ে যায়। আর সহিংস যোগাযোগের ফল তো আর মধুর হবে না, তাই না। তাহলে এই যোগাযোগটা কিভাবে অহিংস করা যায়? সেটাই বলছি।

এরকম পরিস্থিতে প্রথম ধাপে আপনার পর্যবেক্ষণ বলতে হবে। ক্লাস বাতিলের খবর আপনার বন্ধু জেনেও আপনাকে জানায় নাই।

দ্বিতীয় ধাপে আপনার প্রয়োজন বা চাহিদা প্রকাশ করতে হবে। আপনার বন্ধু আপনাকে না জানানোতে আপনার সহযোগিতার যে প্রয়োজন বা চাহিদা ছিল তা পূরণ হয় নি।  

তৃতীয় ধাপে আপনার প্রয়োজন বা চাহিদা পূরণ বা অপূরণ থাকলে আপনার যে অনুভূতি হয় তা প্রকাশ করতে হবে। আপনি সহযোগিতা না পাওয়ায় আপনার কষ্ট বা রাগ বোধ হচ্ছে; আবার আপনার প্রয়োজন/চাহিদা পরিপূর্ণ হলে আপনার অনুভূতি ভিন্ন হতো।  

সবশেষে আপনার প্রয়োজন বা চাহিদা পরিপূর্ণ করতে আপনার সামনের মানুষকে সুনির্দিষ্টভাবে অনুরোধ করতে হবে।

তাহলে NVC’র চারটি উপাদান ব্যবহার করে আপনি উপরের ঘটনায় যেভাবে যোগাযোগ করতে পারেন,

“আমি যখন দেখলাম আজকের ক্লাস বাতিল হওয়ার খবরটি তুমি আমাকে দাও নাই, আমি খুব রাগ বোধ করছিলাম কারণ আমি এক্ষেত্রে তোমার সহযোগিতা পাই নাই। আমি তোমাকে অনুরোধ করছি, এর পরে কখনো ক্লাস রুটিন পরিবর্তন করলে আমাকে জানাইয়ো।”

এভাবে অন্যকে কষ্ট না দিয়ে নিজের প্রয়োজন এবং অনুভূতি প্রকাশের মাধ্যমে সবার সাথে কার্যকরী উপায়ে যোগাযোগ করা সম্ভব।

[প্রশ্ন ২ঃ কোন ধরনের মানুষের সাথে আমি পরামর্শ করতে পারি?]

আপনি আপনার যেকোনো পরিচিত মানুষের সাথেই কথা বলতে পারেন। সেক্ষেত্রে আপনার কাছের এমন কারো সাথে শেয়ার করতে পারেন যে আপনার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনবে, আপনাকে আপনার সমস্যা দিয়ে বিচার করবে না বরং আপনার অনুভূতিগুলো বুঝতে পারবে। এরপরেও যদি আপনি অস্থিরতা কাটিয়ে উঠতে না পারেন এবং দিকনির্দেশনা বুঝতে না পারেন সেক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ মনোবিজ্ঞানীর কাছে কাউন্সেলিং সেবা নিতে পারেন।

[প্রশ্ন ৩ঃ যদি তারা সাইকোলজিস্ট হয় তাহলে ভালো সাইকোলজিস্টদের নাম এবং তারা কোথায় বসেন সেগুলো একটু বলবেন?]

বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে এবং ব্যক্তিগত চেম্বারে মনোবিজ্ঞানীরা কাউন্সেলিং সেবা প্রদান করে থাকেন। এই লিঙ্কে এরকম বিভিন্ন ঠিকানা দেয়া আছে।  

[প্রশ্ন ৪ঃ কিভাবে আমি কমিউনিকেশন স্কিলে একজন এক্সপার্ট হতে পারি এবং তার জন্য কি করতে পারি, কাদের সাথে যোগাযোগ করতে পারি?]

কমিউনিকেশন স্কিল বৃদ্ধির জন্য আপনি বিভিন্ন প্রশিক্ষণ এবং কর্মশালায় অংশগ্রহণ  করতে পারেন। অনেক প্রতিষ্ঠান এবং মনোবিজ্ঞানীরা কমিউনিকেশন স্কিল ডেভেলপমেন্টের উপর বিভিন্ন প্রশিক্ষণ, কর্মশালা পরিচালনা করে থাকেন। তাছাড়া আপনার কলেজের বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনে যুক্ত হয়েও নিজের সামাজিক দক্ষতা বৃদ্ধি করতে পারেন।

আপনার জন্য শুভ কামনা।

Salowa Salam Shaoli
+ posts

Salowa Salam Shaoli is a professional psychologist. She has completed her graduation from Department of Psychology, University of Dhaka and post-graduation on Educational Psychology from the same Institute. She has been involved with counseling in a professional manner since 2016. Apart from that, she was involved in different organizations as Education psychologist, psychosocial adviser, coordinator research and development. Right now she is working as Trainer at Shuchona Foundation.

 

Post Author: Salowa Salam Shaoli

Salowa Salam Shaoli is a professional psychologist. She has completed her graduation from Department of Psychology, University of Dhaka and post-graduation on Educational Psychology from the same Institute. She has been involved with counseling in a professional manner since 2016. Apart from that, she was involved in different organizations as Education psychologist, psychosocial adviser, coordinator research and development. Right now she is working as Trainer at Shuchona Foundation.  

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।