বেঁচেও মরে আছি

মনে হয় আমি বেঁচেও মরে আছি

আমি একটা বেসরকারি ভার্সিটিতে 7th semester পড়ি। রেজাল্ট খুবই খারাপ। আমি প্রথম সেমিস্টার থেকেই চেষ্টা করি পড়ালেখা করার জন্য কিন্তু পারতেছি না। দিনকে দিন খালি একটাই চিন্তা ঘুরে মাথায়, আমি কিভাবে ভাল করে মনোযোগ সহকারে পড়ালেখা করব। কিন্তু পারতেছি না।

যখনই মনোযোগ নিয়ে পড়তে বসি পড়ার মাঝখানেই দেখি মনোযোগ হারিয়ে গেছে। বিভিন্ন নেগেটিভ থট (চিন্তা) মাথায় ঘুরে। এক সময় অস্থিরতা কাজ করে পরে আর পড়ালেখা করতে পারি না। আমি প্রচুর পড়তে চাই কিন্তু পারি না ঘন্টার পর ঘন্টা টেবিলে বসে আছি কিন্তু মনোযোগ নাই। অতীত কিংবা ভবিষ্যৎ এর কথা ভাবি না হলে আগের কোনো তিক্ত অভিজ্ঞতা মনে পরে ভয়ের সৃষ্টি হয়। সন্দেহ জাগে কাজটা করতে পারব কিনা! আমার পারিবারিক ঝামেলা ছিল, এখন আর আগের মত নাই। কিন্তু তারপরও বাসা থেকে ফোন আসলে ভয় কাজ করে, আবার কোন ঝামেলা হল নাকি। আতংকে থাকি, ভয় পাই। আমার বয়স ২৫। আমি এর আগেও আমাদের ভার্সিটির সাইকোলজিস্টের কাছ থেকে কাউন্সিলিং করেছি। মাস ছয়েক বা একটু বেশি হবে। কিন্তু কোন পরিবর্তন হয় নাই আমার। আমি খুবই দুশ্চিন্তা করি। আসলে করতে চাই না এমনিতেই চলে আসে। ফলে আমি অস্থিরতায় ভুগি। চারপাশের কারও সাথে আমার তেমন সম্পর্ক নাই। আমি একা থাকি সব সময়। বন্ধুবান্ধব তেমন কেউ নাই। কারও সাথে মিশে চলাফেরা করতে আমার বিরক্ত লাগে। মনে হয় সময় নষ্ট।

এখন আমি শুধু মনোযোগ সহকারে পড়ালেখা করতে চাই। কিভাবে করব? কি কি করা লাগে? যদি আপনারা দয়া করে সমাধান দেন। আমার অবস্থা খুবই খারাপ। মনে হয় আমি বেচেও মরে আছি। এই পৃথিবীতে কেন আসছি আমি নিজেও জানি না। মাঝে মাঝে মরে যাওয়ার চিন্তা মাথায় আসে।

আমাদের পরামর্শ

প্রথমেই আপনাকে ধন্যবাদ, আপনি আমাদের সাথে আপনার কথাগুলো শেয়ার করেছেন।

আপনার লেখা থেকে একটি বিষয় খুবই পরিষ্কার। সেটা হল, আপনি পড়াশুনা করতে চান। খুবই “মনোযোগ সহকারে, টেবিলে ঘন্টার পর ঘন্টা ব্যয় করে, প্রচুর পড়াশোনা” করতে চান। কিন্তু এর কোনোটাই ঠিকভাবে হচ্ছে না। আপনি চাচ্ছেন এক, হচ্ছে আরেক। পড়াশোনায় গভীর মনোযোগ না আসার জন্য আপনি আপনার অনিয়ন্ত্রিত চিন্তাকে দায়ি করছেন। ক্ষেত্রবিশেষে সেসব চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণ বা অবদমন করার চেষ্টাও করছেন। সেটারও কোনো ভালো ফল হচ্ছে না। আবার পারিবারিক ঝামেলার কথাও আপনাকে আতঙ্কিত করে তোলে, যদিও এখন সেই ঝামেলা কেটে গেছে।

আপনার লেখা পড়ে মনে হচ্ছে, ভবিষ্যতে আপনি অনেক শক্তিশালী একটা ক্যরিয়ার গড়তে চান যার জন্য হয়তবা প্রয়োজন অনেক ভালো রেজাল্ট। অধিকাংশ সময় হয়ত ভবিষ্যতের সেই স্বপ্নের ক্যারিয়ার নিয়েই চিন্তা করেন। ফলে এখনকার ছোট ছোট কাজগুলো করা হয়না। আপনার ভবিষ্যত লক্ষ্য, তার জন্য প্রয়োজনীয় যোগ্যতা আর সেই যোগ্যতা অর্জনের জন্য দৈনন্দিন যা করণীয়, এই বিষয়গুলো নিয়ে আপনার অস্পষ্টতা আছে। এগুলো আপনি যত পরিষ্কার হতে পারবেন, ততই বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন। ফলে কাজে বা পড়াশোনায় প্রয়োজনীয় মনোযোগ দিতে পারবেন।

[আরো পড়ুন-কীভাবে লক্ষ্য নির্ধারন করবেন]

আপনি লিখেছেন পড়ার মাঝে বিভিন্ন নেতিবাচক চিন্তা মাথায় আসছে! সেক্ষেত্রে আপনি একটি “চিন্তার জার্নাল” (Though Journal) তৈরি করতে পারেন, যেখানে আপনার এই চিন্তাগুলো লিখতে পারেন। এই চিন্তার ফলে আপনার কি অনুভূতি হচ্ছে তাও লিখতে পারেন। নেতিবাচক চিন্তার ফলে আপনার অস্থিরতা অনুভব হয়। অস্থিরতা কমানোর একটা কৌশল হল, এই অস্থিরতার ফলে শরীরে যে প্রতিক্রিয়া (Body sensation) হয়, তার দিকে মনোযোগ দেয়া।  যেমন, হার্টবিট বেড়ে যেতে পারে, ঘাম ঝরতে পারে, মাথা ঝিমঝিম ও ব্যথা হতে পারে, পেটের মধ্যে অস্বস্তি হতে পারে। অর্থাৎ শরীরে যেকোনো ধরনের সেনসেশন হলে সেদিকে খেয়াল করা! এতে ধীরে ধীরে আপনার অস্থিরতা কমে যাবে এবং নেতিবাচক চিন্তা থেকে মনোযোগ সরে আসবে।

আপনি পড়তে বসলেই অতীত অথবা ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তিত থাকেন, বর্তমান মুহূর্তে আপনি থাকতে পারছেন না! মাইন্ডফুলনেস (Mindfulness) চর্চার মাধ্যমে আমরা মনকে কিছুটা শান্ত করে বর্তমানে ধরে রাখতে পারি! বিভিন্ন উপায়ে মাইন্ডফুলনেস চর্চা করা যেতে পারে!  একটি পদ্ধতি হতে পারে, পড়তে বসার আগে আপনার রুমের কোন শব্দ একাগ্রচিত্তে শুনুন!

আপনি বলেছেন আপনার পরিবারে কিছু ঝামেলা ছিল, যা এখন ঠিক হয়ে গিয়েছে। যদিও সেসব ঘটনার কিছুই লেখেননি, এখন যখন আপনার বাসা থেকে কল আসে তখন আপনি আতঙ্কিত বোধ করেন এবং ভয় পান। এর থেকে বোঝা যায় এমন কিছু সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলেন যা আপনার জন্য অত্যন্ত চিন্তাদায়ক এবং অসহনীয় ছিল!  এরকম অপ্রত্যাশিত এবং আচমকা ঘটে যাওয়া অনাকাংখিত ঘটনা ঠিক হয়ে গেলেও পরবর্তীতে ওই ঘটনার সাথে যুক্ত কোন ট্রিগার (ঘটনার সাথে সংযুক্ত ব্যক্তি, বস্তু, বা জায়গা এমনকি গন্ধ) পেলেই আবার আগেকার সেই অনুভূতি, যেমন ভয় উদ্বেগ, আতঙ্ক, দুঃশ্চিন্তা, ফিরে আসতে পারে। যেমনটা হচ্ছে আপনার বেলায়। বাসা থেকে কল আসলে আপনি আবার ভয় পাচ্ছেন এবং আতঙ্কিত হয়ে পড়ছেন। একজন পেশাদার সাইকোলজিস্টের কাছে সরাসরি কাউন্সেলিং সেবা নিলে সেগুলো সম্পূর্নরূপে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। আপনার কথা শুনে খুব দুঃখ হচ্ছে যে আপনার বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত সাইকোলজিস্টের কাছে যেয়েও আপনি আশানুরূপ ফল পাননি।

আপনার বন্ধু বা অন্য কারো সাথে মিশতে বিরক্তি লাগে। পড়ালেখাকে বেশি গুরুত্ব দিতে গিয়ে সামাজিক সম্পর্কগুলোকে “সময় নষ্ট” বলে মনে করছেন। একইসাথে আবার পড়ায় মনোযোগও দিতে পারছেন না। বন্ধুবান্ধব এবং সামাজিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ ব্যক্তির মানসিক স্বাস্থ্যের সুস্থতার জন্য দারুণ কার্যকরি। এছাড়াও আপনি খেলাধুলা বা কায়িক পরিশ্রম হয় এমন কোনো ব্যয়াম করে দেখতে পারেন। শুধু চিন্তা দিয়ে চিন্তা দূর করা যায় না। অনেকসময় শরীরের যত্নের মাধ্যমে মনকে সবল করা যায়।

ঠিক কতদিন ধরে মরে যাওয়ার চিন্তা মাথায় আসছে, তা পরিষ্কার না। যদি বারবার এই চিন্তা আসতে থাকে তাহলে একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন। এছাড়াও তীব্র খারাপ লাগার মুহূর্তে এবং নিজেকে মেরে ফেলার চিন্তা মাথায় আসলে দেশে প্রচলিত কিছু মানসিক স্বাস্থ্যসেবা এবং আত্মহত্যা প্রতিরোধক হেল্পলাইনে কল দিয়ে আপনার মনের কথা খুলে বলতে পারেন। আর অবশ্যই প্রফেশনাল সাইকোলজিস্টের কাছে কাউন্সেলিং নিতে পারেন যাতে করে আপনার পরিবর্তন দীর্ঘদিনের জন্য স্থায়ী হয়।

আপনার জন্য শুভকামনা।

Salowa Salam Shaoli
+ posts

Salowa Salam Shaoli is a professional psychologist. She has completed her graduation from Department of Psychology, University of Dhaka and post-graduation on Educational Psychology from the same Institute. She has been involved with counseling in a professional manner since 2016. Apart from that, she was involved in different organizations as Education psychologist, psychosocial adviser, coordinator research and development. Right now she is working as Trainer at Shuchona Foundation.

 

Post Author: Salowa Salam Shaoli

Salowa Salam Shaoli is a professional psychologist. She has completed her graduation from Department of Psychology, University of Dhaka and post-graduation on Educational Psychology from the same Institute. She has been involved with counseling in a professional manner since 2016. Apart from that, she was involved in different organizations as Education psychologist, psychosocial adviser, coordinator research and development. Right now she is working as Trainer at Shuchona Foundation.  

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।