আপনার মনে কি চিন্তা ঘুরছে?

সফলতার আদ্যোপান্ত (পর্ব-৩): আবেগের খেলাঘর

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকে ঢুকলেই আমরা একটা প্রশ্নের সম্মুখীন হই, ‘হোয়াটস অন ইয়োর মাইন্ড?’ যার সোজা বাংলা দাঁড়ায়, ‘আপনার মনে কি চিন্তা ঘুরছে?’। সেই প্রশ্নে সারা দিয়ে আমরা ফেইসবুকে নানান  সময়ে নানান কিছু বলি। অর্থাৎ আমাদের চিন্তাভাবনাগুলো অন্যদের সাথে শেয়ার করি। আবার আমাদের বক্তব্যকে আরো বোধগম্য করার জন্য বিভিন্ন ধরনের ফিলিং বা অনুভূতি যোগ করারও ব্যবস্থাও আছে। বক্তব্যের সাথে আমরা আবেগ-অনুভূতি যুক্ত করে বলে থাকি, ফিলিং স্ট্রেসড (মানসিক চাপে আছি), ফিলিং হোপফুল (আশাবাদী বোধ করছি), ফিলিং কনফিডেন্ট (আত্মবিশ্বাসী বোধ করছি) ইত্যাদি।

সহজভাবে বললে চিন্তা বা চিন্তন হল কোন একটা বিষয় বা ঘটনা সম্পর্কে আমাদের নিজস্ব ভাবনা বা সেই ঘটনা সম্পর্কে আমাদের নিজস্ব ব্যাখ্যা। অন্য সবকিছুর মত এটাও একটা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ঘটে।অন্যদিকে অনুভূতি হল কোন একটা বিষয় বা ঘটনা বা চিন্তার ফলে আমাদের ভেতরের যে প্রতিক্রিয়া বা শারীরিক পরিবর্তন। ধরুন, ভুমিকম্প হচ্ছে-এটা একটা ঘটনা বা পরিস্থিতি। ফলে সাথে সাথে আপনার চোখের তাড়া বড় হয়ে গেল, গলা শুকিয়ে গেল, হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল, বা হাত-পা কাঁপতে লাগলো অর্থাৎ আপনার ভয়ের অনুভূতি হচ্ছে। তারপর আপনি বের হবেন কিনা, কাউকে ফোন করবেন কিনা, মরে যাচ্ছেন কিনা এসব নিয়ে ভাবতে লাগলেন বা চিন্তা করতে লাগলেন। এবং তারপর আপনি মাথার ওপর বালিশ দিয়ে একটি পিলারের নিচে দাঁড়িয়ে থাকলেন, এটা হল আপনার আচরণ। এরকম আমাদের চারপাশে প্রতিনিয়ত নানা ঘটনা বা পরিস্থিতি তৈরি হয় এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের অনুভূতি, চিন্তা, এবং আচরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায়।  

এ পর্যন্ত এতটুকু পরিষ্কার যে চিন্তা, অনুভূতি এবং আচরণ এক বিষয় নয়, যা আমরা প্রায়ই গুলিয়ে ফেলি। এদের মধ্যে খুব শক্তিশালী যোগসূত্র থাকলেও এরা ভিন্ন। চিন্তার বসবাস আমাদের মাথায়, যাকে মনও বলা হয়ে থাকে। অর্থাৎ আমাদের মস্তিষ্কের একটি নির্দিষ্ট এলাকা এই চিন্তা প্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। আর আবেগ-  অনুভূতির বসবাস আমাদের শরীরে। যদিও মস্তিষ্কেরই একটি অংশ আবেগ অনুভূতির সাথে সম্পৃক্ত, কিন্তু আমরা অনুভূতিগুলো অনুভব করি শরীরে। সেই অর্থে শরীরই হলো আবেগের খেলাঘর। আমাদের একেকটা অনুভূতির শারীরিক প্রতিক্রিয়া একেক রকম। আবার একই অনুভূতি একেকজনের শরীরে একেক রকম সংবেদন সৃষ্টি করতে পারে।

চিন্তা, অনুভূতি এবং আচরণ এক বিষয় নয়
চিন্তা, অনুভূতি এবং আচরণ এক বিষয় নয়

আবেগীয় বুদ্ধি বাড়ানোর জন্য অনুভূতিগুলোকে বুঝতে পারা খুবই জরুরি। আর অনুভূতিগুলোকে আমরা  শারীরিক প্রতিক্রিয়া বা সিগনালের মাধ্যমেই বুঝতে পারি। অর্থাৎ আবেগ অনুভূতির ব্যবস্থাপনা তখনই সম্ভব যখন আমরা আমাদের বিভিন্ন শারীরিক প্রতিক্রিয়ার ভিত্তিতে সেগুলোকে সনাক্ত করতে পারব। যেমন, ধরুন, রাস্তায় আপনি হন্যে হয়ে রিকশা খুঁজছেন। অবশেষে একটি রিক্সার দেখা মিললেও রিক্সা চালক ৩০ টাকার ভাড়া ৭০ টাকা চাইছে। ভাড়া শোনার পর আপনার প্রচণ্ড রাগ বোধ হলো। এক্ষেত্রে আপনার পর্যাপ্ত আবেগীয় বুদ্ধি থাকলে আপনি এক ধরনের আচরণ করবেন, আবার আবেগীয় বুদ্ধির ঘাটতি থাকলে আরেক ধরনের আচরণ করবেন। যেমন আপনার আবেগীয় বুদ্ধির ঘাটতি থাকলে, আপনি রিকশাচালককে কড়া করে দু-এক কথা শুনিয়ে দেবেন বা গালমন্দ করবেন বা ঝগড়া করবেন, অথবা চুপচাপ মেজাজ গরম নিয়ে সারাটা দিন কাটিয়ে দেবেন বা নির্দোষ কারো উপর রিক্সা চালকের রাগটা ঝেড়ে ফেলবেন, অথবা এমন কিছু করবেন যেটা আপনার জন্য কোনরকম সুফল আনবে না। অন্যদিকে পর্যাপ্ত আবেগীয় বুদ্ধি থাকলে আপনি রিকশাচালকের মুখে ভাড়া শুনেই শরীর যে সিগনাল দেবে তা থেকে বুঝে যাবেন যে আপনার রাগ বোধ হচ্ছে। ফলে আপনি সচেতন থাকবেন, যথাযথভাবে রাগ ব্যবস্থাপনা করবেন, এবং ভুলভাল আচরণ না করে যথাযথ আচরণ করতে সমর্থ হবেন। সুতরাং অনুভূতির শারীরিক প্রতিক্রয়াগুলো জানা থাকলে রাগসহ অন্যান্য যেকোন অনুভূতির ব্যবস্থাপনা সহজ হয়ে যায়।

নিচে কিছু মৌলিক অনুভূতি এবং তাদের সচরাচর শারীরিক প্রতিক্রিয়ার একটি তালিকা দেয়া হল।

অনুভূতি

শারীরিক প্রতিক্রিয়া বা সিগনাল

রাগ

মাথা গরম হওয়া বা ঝিমঝিম করা, শরীর কেঁপে ওঠা, হৃদস্পন্দন বৃদ্ধি পাওয়া, দ্রুত ও ঘন শ্বাসপ্রশ্বাস, ঘাড় বা পুরো শরীর শক্ত হয়ে যাওয়া, চোখের তাড়া বড় হয়ে যাওয়া বা চোখ লাল হয়ে যাওয়া, চোখে পানি চলে আসা, শরীরে বাড়তি শক্তি অনুভূত হওয়া ইত্যাদি।

ভয়

গলা শুকিয়ে যাওয়া, হাত পা ঠাণ্ডা হওয়া, শরীর এবং কণ্ঠস্বর কেঁপে ওঠা, হৃদস্পন্দন বৃদ্ধি পাওয়া, দ্রুত ও ঘন শ্বাসপ্রশ্বাস, শরীর ঘেমে যাওয়া  ইত্যাদি।

দুঃখ

শরীর নুইয়ে পড়া, ক্লান্তি, অবসাদ, মাথা ধরা বা মাথা ব্যাথা, ঘাড়ে ব্যাথা বা অস্বস্তি লাগা, কান্না পাওয়া ইত্যাদি।

খুশী

স্বাভাবিক শ্বাসপ্রশ্বাস, শরীরে উদ্যম ও প্রাণশক্তির সঞ্চারণ, শরীরের জড়তা কেটে ফুরফুরে লাগা ইত্যদি।

এই পর্বে আপনার কাজ হলো উপরের চারটি অনুভূতির ক্ষেত্রে আপনার নিজের শারীরিক প্রতিক্রিয়া বা সিগনালগুলোকে সনাক্ত করা। তারপর একটি খাতায় উপরের ছকটির মত একটি ছক এঁকে আপনার এই চারটি  অনুভূতির শারীরিক সিগনালগুলো লিখে ফেলা। পরবর্তী পর্বে থাকবে অনুভূতির ব্যবস্থাপনা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা। পড়তে থাকুন।

 
রাউফুন নাহার
+ posts

রাউফুন নাহার মাস্টার্স করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশনাল অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগ থেকে এবং অনার্স করেছেন একই বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগ থেকে। বর্তমানে এডুকেশনাল এন্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগে প্রভাষক হিসেবে কর্মরত আছেন। ভালোবাসেন মানুষ, প্রকৃতি আর তাদের ভেতরের অন্তর্নিহিত সুরকে।

Post Author: রাউফুন নাহার

রাউফুন নাহার মাস্টার্স করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশনাল অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগ থেকে এবং অনার্স করেছেন একই বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগ থেকে। বর্তমানে এডুকেশনাল এন্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগে প্রভাষক হিসেবে কর্মরত আছেন। ভালোবাসেন মানুষ, প্রকৃতি আর তাদের ভেতরের অন্তর্নিহিত সুরকে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।