একজন পাগল

একজন পাগল, যে বদলে দিয়েছিল পাগলের সংজ্ঞা

ভাইদের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। আগে থেকেই পরিবারে ছিল মানসিক সমস্যার ইতিহাস । আপন খালাই ছিলেন মানসিক বিকারগ্রস্থ। আর কিশোর বয়সেই মৃগীরোগের লক্ষণ প্রকাশিত হবার পর অল্প বয়সেই মারা যান বড়ভাই। এছাড়াও আরো তিন ছোট ভাইয়েরও মৃত্যু হয় মানসিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসা গ্রহণ করা অবস্থাতেই। যাদের মধ্যে দু’জনের মৃত্যুর কারণ আত্মহত্যা।

চাকুরীজীবনে প্রবেশের পর ক্রমাগত বাড়তে থাকা মর্মপীড়া সহ্য করতে না পেরে কর্মক্ষেত্র ছেড়ে বাড়ী ফিরে আসেন।  বয়স তখন মাত্র চব্বিশ। এ সময় তিনি নিজেও নিজ কক্ষের জানালা থেকে ঝাপিয়ে পড়ে আত্মহত্যার চেষ্টা চালান। দীর্ঘদিন হাসপাতালে চিকিৎসা গ্রহণ করে বাড়ী ফিরে আসার পর এতটাই ভেঙ্গে পড়েন যে, কথা বলা বন্ধ করে দেন। চিকিৎসা গ্রহণ অবস্থাতেই তিনি আক্রান্ত হন বিষন্নতা ও প্যারানইয়ায় (একপ্রকার মস্তিষ্ক বিকৃতি জনিত রোগ)। এছাড়া তিনি অলীক বীক্ষণ বা হ্যালুসিনেশনেও আক্রান্ত ছিলেন। শারীরিক ও মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়ে বিভিন্ন মানসিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসাধীন অবস্থায় কেটে যায় তিনটি বছর। এ দীর্ঘ সময়ে স্বাস্থ্যকেন্দ্রের কর্মচারীদের দ্বারা নানাভাবে ক্রমাগত শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার  হন। যা তার মনে গভীরভাবে রেখাপাত করে। তৎকালে মানসিক রোগগ্রস্থদের প্রতি প্রবল নেতিবাচক ধারণা ছিল। অস্বাভাবিক কোনোকিছুর প্রভাবে তারা প্রভাবিত বলে ধারণা করা হতো। পরবর্তীতে অনেকটা স্বপ্রণোদিত হয়েই তিনি সুস্থ্য হয়ে ওঠেন। তাঁর জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো নিয়ে লিখেন আত্মজীবনী, বিশেষ করে হাসপাতালে উৎপীড়িত হওয়ার ঘটনাগুলো, যেগুলো তাঁকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল।

বলছিলাম ক্লিফোর্ড উইটিংহাম বিয়ার্স-এর (১৮৭৬-১৯৪৩) কথা। যিনি “A mind that found itself (1908)” বইয়ের লেখক। এই বইটি ছিল মানসিক স্বাস্থ্যের ইতিহাসে এক মাইলস্টোন। অত্যন্ত মর্মস্পর্শী ভাষায় তিনি বলতে চেয়েছেন  মানসিক রোগীরাও মানুষ। বইটি প্রকাশিত হওয়ার পর গোটা আমেরিকায় আলোড়ন সৃষ্টি হয় । নড়ে-চড়ে বসেন সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ। এরপরই মানসিকভাবে অসুস্থ্য ব্যক্তিদের চিকিৎসার ক্ষেত্রে বিজ্ঞানসম্মত চিন্তার সূত্রপাত হয়। ১৯০৮ সালে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের সহযোগিতায় কানেকটিকাটে বিয়ারস গড়ে তোলেন ‘ন্যাশনাল কমিটি ফর মেন্টাল হাইজিন’ নামক প্রতিষ্ঠান, যা বর্তমানে ‘মেন্টাল হেলথ আমেরিকা’ নামে পরিচিত। এর উদ্দেশ্য ছিল মানসিক রোগের কারণ সংক্রান্ত গবেষণায় ও মেডিক্যাল শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত প্রশিক্ষণের জন্যে অর্থ সহায়তা জোগাড়। “Mental Hygiene and Understanding the Child” নামে তারা একটি পাক্ষিক ম্যাগাজিনও প্রকাশ করেন। এর ফলে বিভিন্ন প্রদেশেও সচেতন নাগরিকরা অনুরুপ কমিটি গড়ে তোলেন। এক্ষেত্রে বিশেষভাবে সহায়তা করেছিলেন জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইকিয়াট্রি বিভাগের অধ্যাপক এ্যাডলফ্‌ মেয়ার। ‘Mental Hygiene’ শব্দটি তিনিই সর্বপ্রথম ব্যবহার করেন এবং এ বিষয়ের উপর মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ লেখালেখি তার বিশেষ অবদান। ব্যক্তিজীবনে তিনি একজন বিখ্যাত মনোচিকিৎসক ছিলেন।

নিরলস পরিশ্রম ও সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টির ক্রমাগত প্রচেষ্টার ফলস্বরুপ ১৯৩০ সালে বিয়ার্স-এর তত্বাবধানে ‘ওয়াশিংটন ডিসি’তে অনুষ্ঠিত হয় ইন্টারন্যাশনাল কংগ্রেস ফর ন্যাশনাল হাইজিন, যাতে ৫১টি দেশের প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেন। এই সম্মেলনকে বিয়ার্স-এর জীবনের সর্বোচ্চ চূড়া হিসেবে গণ্য করা হয়। মানবতার জন্য বিশেষ অবদান রাখায় পরবর্তীতে ইয়েল ইউনিভার্সিটি থেকে তাঁকে একটি সম্মানসূচক  ডিগ্রি প্রদান করা হয়। উল্লেখ্য, তিনি এই প্রতিষ্ঠানেরই প্রাক্তন শিক্ষার্থী ছিলেন।

ব্যক্তিজীবনে বিয়ার্স ছিলেন নিঃসন্তান। মানসিক সমস্যার ইতিহাস থাকায় স্ত্রী ক্লারা লুইস জিপসন ও বিয়ার্স সন্তান না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।

১৯৪৩ সালে সাতষট্টি বয়সে রোডে দ্বীপের একটি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে বিয়ার্স-এর জীবনাবসান ঘটে। বিয়ার্স চলে গেছেন তবে তার স্বপ্নের সাফল্যগাথা লিপিবদ্ধ রয়ে গেছে ইতিহাসে। মানসিক সীমাবদ্ধতার কাছে হার না মেনে আজীবন লড়ে গেছেন তিনি।

এরপর কেটে গেছে দীর্ঘ সময়। মানসিক স্বাস্থ্য বিজ্ঞান স্থান করে নিয়েছে জাতীয় জীবনের অপরিহার্য বিষয়াবলির সাথে। সমাজের সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে কারো কারো যে সীমাবদ্ধতা, তার কারণ ও প্রতিকার নিয়ে গবেষণা করে বাস্তব জীবনের সমস্যাগুলোর সমাধান করতে চেষ্টা করে যাচ্ছেন সমাজবিজ্ঞানী ও মনোবিজ্ঞানীরা।

সভ্যতা এগিয়েছে, বিজ্ঞান তার বিস্ময়কর সব আবিষ্কার দিয়ে প্রতিদিনই চমকে দিচ্ছে বিশ্বকে। মানবমনের রহস্য ও গতি-প্রকৃতি নিয়েও কম হয়নি গবেষণা। তবে মানুষ মানুষকে জেনেছে সামান্যই।

সুমাইয়া তাসনিম
+ posts

শিক্ষার্থী, মনোবিজ্ঞান বিভাগ

ইডেন মহিলা কলেজ, ঢাকা।

Post Author: সুমাইয়া তাসনিম

শিক্ষার্থী, মনোবিজ্ঞান বিভাগ ইডেন মহিলা কলেজ, ঢাকা।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।