পাঁচটি উপাদান বা সত্তা পাওয়া

তোমার ঘরে বসত করে কয়জনা!

আব্দুর রহমানের বড় ছেলে মেহেদি তিন দিন ধরে নিখোঁজ। দুশ্চিন্তায় বাড়ির প্রত্যেকেই দিশেহারা! আকাশ পাতাল করেও কোথাও খোঁজ মিলছে না তার।

না, এটা খুন-গুমের কোন গল্প নয়, বরং  নিখোঁজ হবার চতুর্থ দিন অক্ষত অবস্থায় বাড়ির সদর দরজায় হাজির হয় মেহেদি, সঙ্গে সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী। কলিঙয়ের ঘন্টা শুনে ছুটে গিয়ে দরজা খোলেন আব্দুর রহমান নিজেই। তারপর… নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন কিছুক্ষণ। এদিকে ‘যেন কিছুই হয়নি’ ভাব করে মেহেদি নতুন বউকে বলে, ‘উনি আব্বা, যাও সালাম কর!’

এমন পরিস্থিতিতে আব্দুর রহমানের প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে? দেখে নিই সম্ভাব্য উত্তরগুলো-

প্রতিক্রিয়া ১- আব্দুর রহমান ভ্রু কুঁচকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কই ছিলা? সাথে কে এইটা? কোন ভদ্র বাড়ির ছেলেপুলে এইভাবে বিয়া করে? বেয়াদব! দূর হ! এই মুহূর্তে আমার চোখের সামনে থেকে দূর হ!’।

প্রতিক্রিয়া ২- তিনদিন পর অক্ষত অবস্থায় ছেলেকে ফিরে পেয়ে বুকে জড়িয়ে ধরলেন আব্দুর রহমান। তারপর বউসমেত ছেলেকে ঘরে তুলে নিলেন সাদরে।

প্রতিক্রিয়া ৩- ঘটনা আন্দাজ করতে পেরে আব্দুর রহমান ছেলে-বউকে নিয়ে ঘরে ঢুকলেন এবং বাড়ির অন্য সকলকে ডাকলেন। তারপর শান্তভাবে ঘটনা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চাইলেন।

প্রতিক্রিয়া ৪- ছেলেকে এই অবস্থায় দেখে রাগে, ক্ষোভে আব্দুর রহমানের মাথায় আগুন ধরে গেল। তিনি কষে দুটো থাপ্পর লাগালেন ছেলের গালে! বাকিটা ইতিহাস।

প্রতিক্রিয়া ৫- আদরের ছেলের এহেন কর্মে আব্দুর রহমান বড্ড কষ্ট পেলেন। তিনি দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে ছেলেকে বললেন, ‘যা খুশি করে বেড়াও, আমি এই ঘর-সংসার ছেড়ে দু’চোখ যেদিকে যায় চলে যাব’।

প্রিয় পাঠক, কেন মাত্র একটি ঘটনার প্রেক্ষিতে এই এতগুলো প্রতিক্রিয়ার সম্ভাবনা থাকে? এর কারণ হল আমাদের প্রত্যেকের ভেতর একাধিক সত্তা থাকে। ঠিক যেমন মনোবিদ এরিক বার্ন মনে করেন, আমাদের প্রত্যেকের ব্যক্তিত্ব মূলত তিনটি উপাদান বা সত্তার সমন্বয়ে গঠিত। এই তিনটি মূল উপাদানকে ভাঙলে মোট পাঁচটি উপাদান বা সত্তা পাওয়া যায়। উপরের পাঁচটি প্রতিক্রিয়া মুলত এই পাঁচ ধরনের সত্তার এক একটি থেকে এসেছে।

আজকের এই লেখাটি তাদের জন্য, যারা নিজেকে জানতে চান।

ট্রানজ্যাকশনাল এনালাইসিসের প্রবক্তা, এরিক বার্ন ব্যক্তিত্বের মূল যে তিনটি উপাদান বা সত্তার কথা বলেছেন সেগুলো হল-

  • পিতা-মাতা সত্তা (Parent ego state)
  • পরিপূর্ণ সত্তা (Adult ego state)
  • শিশু সত্তা (Child ego state)

ধরুন, আপনার বয়স ২০, তবুও এই তিনটি সত্তাই আপনার ভেতর বিরাজমান। অর্থাৎ যেকোনো বয়সের মানুষের ভেতরেই কম-বেশি এই সবগুলো সত্তাই রয়েছে। এবার জেনে নেয়া যাক এসকল সত্তার বৈশিষ্ট্য এবং আচরণে এদের প্রভাব।

পিতা-মাতা সত্তা (Parent)

আমাদের ব্যক্তিত্বের পিতা-মাতা সত্তাটি বেশ কতকগুলো  চিন্তাধারা, দৃষ্টিভঙ্গি এবং মুল্যবোধের সমষ্টি। এই সত্তাকে ভাগ করলে পাওয়া যায়-

  • সমালোচক পিতা-মাতা সত্তা (Critical Parent)- এই সত্তার প্রভাবে আমরা নিজস্ব চিন্তাধারার আলোকে অন্যকে খাটো করার চেষ্টা করি, শাসন করি, সমালোচনা করি, নিয়ম বা মুল্যবোধ চাপিয়ে দেই, ভুল ধরি এবং কখনও কখনও নিজের প্রতিও ক্রিটিক্যাল হয়ে পড়ি। আব্দুর রহমান যদি সম্ভাব্য প্রথম প্রতিক্রিয়াটি করে থাকেন তাহলে সেটি তিনি করে থাকবেন তার সমালোচক পিতা-মাতা সত্তা থেকে। অর্থাৎ সেই সময় তার ব্যক্তিত্বে সমালোচক পিতা-মাতা সত্তাটি প্রকট হয়ে উঠেছে।  
  • স্নেহশীল পিতা-মাতা সত্তা (Nurturing Parent)- যখন আমরা স্নেহশীল পিতা-মাতা সত্তা থেকে আচরণ করি, তখন আমরা নিজের বা অন্যের যত্ন করি, খেয়াল রাখি, ভালবাসি, মন থেকে গ্রহন করি, উৎসাহ-উদ্দীপনা যোগাই, প্রশংসা এবং সহযোগিতা করি। আব্দুর রহমানের সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া-২ এ এমনটাই দেখা যায়।

 

পরিপূর্ণ সত্তা (Adult)

আমাদের ব্যক্তিত্বের পরিপূর্ণ বা অ্যাডাল্ট সত্তাটি খুব যৌক্তিক এবং বাস্তববাদী। এই সত্তার প্রভাবে আমরা কোনো সিদ্ধান্তে উপনিত হবার আগে তথ্য-প্রমান খুঁজি, অনুসন্ধান করি এবং যৌক্তিকভাবে চিন্তা করি।ঠিক যেমন আব্দুর রহমানের সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া-৩। এই সত্তার আর কোনো ভাগ হয়না।

শিশু সত্তা (Child)

আমাদের ব্যক্তিত্বের শিশু সত্তাটিও দুইভাগে বিভক্ত

  • মুক্ত শিশু সত্তা (Free Child)- মুক্ত শিশু স্বতঃস্ফূর্ত, নিয়ন্ত্রনহীন, আত্মকেন্দ্রিক,অস্থির, প্রবৃত্তি দ্বারা তাড়িত এবং আনন্দের পূজারী। যেমন, সকল প্রকার জৈবিক চাহিদাপূরণ,রাগ-অভিমান ঝেড়ে ফেলা, নিজের বিনোদনের জন্য কিছু করা ইত্যাদি। আব্দুর রহমানের সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া-৪ এই সত্তারই দৃষ্টান্ত।রাস্তার পাশে গাছের কোনো নিচু ডাল দেখে যদি আপনার লাফিয়ে উঠতে ইচ্ছে করে, বুঝবেন আপনার মুক্ত শিশু সত্তাটি সেটা চাইছে।
  • অনুগত শিশু সত্তা (Adaptive Child)-আমাদের ভেতরের অনুগত শিশুটি সবকিছু মেনে নিয়ে ভাল থাকতে চায়। অবশ্য মাঝে মাঝে চাপা অভিমানে মুখ গোমরা করে থাকে এবং নিজেকে কষ্ট দেয়। আব্দুর রহমানের পঞ্চম সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়াটি এই সত্তা থেকেই এসেছে।

মজার ব্যাপার হল আমরা যখন যে আচরণই করি না কেন, তার পেছনে থাকে এই তিনটি সত্তারই কোন একটি।মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, আমাদের ব্যক্তিত্বের মধ্যে সবকটি সত্তার সুষম অবস্থান থাকা সুস্থ মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য জরুরি। কোনো একটি বা দুটি সত্তার অধিক আধিপত্য থাকলে মানসিক স্বাস্থ্যে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। কেননা, এই সত্তাগুলো এমনভাবে বিরাজ করে যাতে একটি যদি খুব বেশি প্রকট থাকে, তাহলে অন্যগুলো কম থাকবে। আর তাতেই দেখা যেতে পারে অসুবিধা।

এবার ভেবে দেখুন আপনার আচরণে মূল তিনজনার মধ্যে কোন জনার প্রভাব  কতখানি!

রাউফুন নাহার
+ posts

রাউফুন নাহার মাস্টার্স করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশনাল অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগ থেকে এবং অনার্স করেছেন একই বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগ থেকে। বর্তমানে এডুকেশনাল এন্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগে প্রভাষক হিসেবে কর্মরত আছেন। ভালোবাসেন মানুষ, প্রকৃতি আর তাদের ভেতরের অন্তর্নিহিত সুরকে।

Post Author: রাউফুন নাহার

রাউফুন নাহার মাস্টার্স করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশনাল অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগ থেকে এবং অনার্স করেছেন একই বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগ থেকে। বর্তমানে এডুকেশনাল এন্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগে প্রভাষক হিসেবে কর্মরত আছেন। ভালোবাসেন মানুষ, প্রকৃতি আর তাদের ভেতরের অন্তর্নিহিত সুরকে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।