আমার বাবা একজন সরকারি কর্মকর্তা। ২০১৪ পর্যন্ত আমি ছিলাম ভয়াবহ রকমের ইন্ট্রোভার্ট। কারো সঙ্গে একটা কথা বলা কিংবা সাহায্য চাওয়া থেকে বিরত থাকতাম। কিন্তু ২০১৪-তে এসে নিজের ইচ্ছার বিরূদ্ধেই সম্পূর্ণভাবে মানুষের সাথে মেশা শুরু করি। এটা বলে রাখা ভাল, ছোটবেলা থেকেই আমাকে অন্য অফিসারের বাচ্চাদের সাথে মিশতে দেয়া হয় নি। একটা ঘটনা ঘটেছিল ২০১৪ সালে। ইংরেজি মাধ্যমের এক ছেলে আমার একটা ভুল ইংরেজির স্ক্রিনশট তুলে আমাকে পচাইছিল। তারপর থেকেই আমি ইংরেজি মাধ্যমের ছেলেদের ব্লক করতে থাকি ও ভয় পেতে থাকি। মেশা শুরু করি বাংলা মিডিয়ামের কর্মচারীদের ছেলেমেয়েদের সাথে। যেহেতু আমি নিজেও বাংলা মিডিয়ামে পড়ি। পরের বছর (২০১৫) একজন কর্মচারীর মেয়েকে আমার ভাল লাগা শুরু হয়। কিন্তু সে সবার সামনে আমাকে বেইজ্জত করে। যা আমি মেনে নিতে পারি নাই। এর পরের বছর (২০১৬ সালে) আমার পেন্ড্রাইভ, ছাতা, স্ট্যাপ্লার, মোবাইল সব হারাইতে থাকে। আর সিনিয়র কর্মকর্তাদের ছেলেমেয়েরা কেন যেন আমার বিরূদ্ধে হাসাহাসিতে লিপ্ত থাকে। থাকত কিনা জানি নাহ, অন্তত আমার তাই মনে হতো। তো এর পরে আমি আমার নিজের কোয়ার্টারের ছেলেমেয়েদের ভয় পেতে শুরু করি।
বছরের শেষ দিকে আমি ইচ্ছার বিরূদ্ধে আমার কোয়ার্টারের দুই মেয়ে ক্লাসমেটের সাথে বন্ধুত্ব শুরু করি। যদিও ইতোমধ্যে আমি আরেকজন কর্মচারির মেয়েকে প্রপজ করি এবং প্রত্যাখাত হই। তারপর আমার সেই দুইজন মেয়ে বন্ধুর সঙ্গেই ইচ্ছার বিরূদ্ধে যোগাযোগ বৃদ্ধি পেতে থাকে। উল্লেখ্য আমি বরাবরই প্রথম দিকের ছাত্র। তাই বরাবরের মতো কলোনীর অফিসার ও তাদের মিসেসদের কাছে আমি আদৃত ছিলাম । তারপর, আমি আমার সেই দুই বান্ধবীর একজনের প্রেমে পড়ে যাই। কলেজে ওঠার পর তাকে প্রেমের প্রস্তাব দেই এবং যথারীতি প্রত্যাখাত হই। আমি তাকে কল্পনায় রাখি সবসময়। তার বাবা সিনিয়র অফিসার। তার উপর দিয়ে কলেজে পড়ার চাপ। ১৮ বছর বয়সে এসে জীবনে প্রথম বার আমি মাস্টারবেট করি। সবকিছু আমাকে হতাশার শেষ সীমানায় নিয়ে গেছে।
এতকিছুর পর, বাবার প্রমশন না হওয়াতে আমি সিনিয়র অফিসারদের বাচ্চাদের কাছে যাইতেও লজ্জা পাচ্ছি। আর সবকিছুর উপর, আমি অফিসারের ছেলে হয়া সত্ত্বেও সরকারি এক পরীক্ষায় ফেল করেছি। অর্থাৎ সেখানেও প্রত্যাখ্যাত। আমাকে যারা পচাইছিল, তারা কোনো দিক থেকেই আমার সাথে দাঁড়াইতে পারবে নাহ। তারপরেও ওদের চাকরি হয়ে গেছে। নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছা করছে। সারা জীবন কি পেলাম? খালি হতাশা! আমি নামাজ পড়ি। আল্লাহ কোন পরীক্ষা নিচ্ছেন, তিনিই জানেন। আপনারাই পারেন কিনা উদ্ধার করতে দেখুন। আমি সারাদিন একা একা কথা বলি। আমার নার্ভ কন্ট্রোল হয় নাহ। নিরাপত্তাহীণতায় ভুগি। অফিসারের বাচ্চাদের দেখলে মারতে ইচ্ছা হয়। আমার মনে হয়, কেউ আমাকে কিডন্যাপ করবে, বাসে উঠলে টাকা না থাকলে আমার কি হবে। বিয়ে করতে ইচ্ছা হয়। পড়্রাশুনার অবস্থা নাই। আত্মীয় স্বজনকে সহ্য হয় নাহ আর। কোন ফ্রেন্ড বিশেষকরে অফিসারের ছেলের কাছ থেকে কিছু চাইতে ইচ্ছা হয় নাহ। মা-কে আমি সব কথা খুলে বলি। অনেক কারণেই বোনের সঙ্গে সম্পর্ক আমার কেন জানি ভাল নাহ। বাবা আমাকে আদরই করেন। আমার বাবা-মা’র মধ্যেও তেমন ঝামেলা নাই। আমি এখন কি করব?
আমাদের পরামর্শ
মনযোগী মন-এ আপনার মনের কথাগুলো খোলামেলা লিখে পাঠানোর জন্য ধন্যবাদ। প্রথমেই বলে রাখা প্রয়োজন যে, মনোসামাজিক যেকোনো সমস্যার সমাধান মানে মনোবিজ্ঞানীদের কিছু নির্দেশনা নয়, বরং তাদের সাহায্যে আপনার সমস্যার উৎসগুলো খুঁজে বের করা এবং পরবর্তীতে নিজ উদ্যোগে সমস্যা সমাধানে সিদ্ধান্ত নেয়া। এই প্রশ্নোত্তরে মূলত সমস্যার উৎসগুলোর উপরই বিশেষত আলোকপাত করার চেষ্টা করেছি।
বর্তমানে আপনি আঠারো বছরের একজন তরুণ। লেখা থেকে দেখা যাচ্ছে ২০১৪ সালে আপনার বয়স যখন প্রায় চৌদ্দ বছর, তখন আপনার জীবনে বেশ কিছু পরিবর্তন এসেছিল। সেসময় আপনি কিছু বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখীনও হয়েছিলেন। যা থেকে উদ্ভুত কিছু নেতিবাচক চিন্তা এবং অনুভুতি আপনি এখনও বয়ে বেড়াচ্ছেন। যা আপনার বর্তমান পথচলাকে ভীষণভাবে বাধাগ্রস্থ করছে। এখানে বলে রাখা প্রয়োজন যে, ১৩-১৪ বছর বয়সটা জীবনের খুব গুরুত্বপূর্ণ এক সময়, যাকে ক্রান্তিকালও বলা চলে। কারণ এই বয়সে ছেলেমেয়েদের মধ্যে অনেক শারীরিক এবং মানসিক পরিবর্তন ঘটতে থাকে, যা মানববিকাশের একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। এ সময় অধিকাংশ কিশোরকিশোরী তাদের নিজেদের পরিবর্তন এবং তাদের প্রতি আশেপাশের মানুষের আচরণের বিভিন্ন দিক নিয়ে নানাধরনের দ্বন্দ্বে ভুগে থাকে।
সময়ের সাথে সাথে পারিপার্শ্বিক পরিবেশ এবং সেখানে বসবাসরত মানুষগুলোর, যেমনঃ পরিবার, শিক্ষক, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবি, সহায়তায় অনেকেই এই দ্বন্দ্ব থেকে মুক্ত হয়। তাদের জন্য এই সময়টা উপভোগ্য হয়ে উঠে। অপরপক্ষে, এই সময়ের দ্বন্দ্বগুলো সমাধানের ক্ষেত্রে যদি কিশোরকিশোরীরা পারিপার্শ্বিক পরিবেশ থেকে যথাযথ সহযোগিতা না পায় অথবা ক্রমাগত নেতিবাচক পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়, তাহলে তাদের স্বাভাবিক বিকাশ বাধাপ্রাপ্ত হয়। তখন এ সময় ও পরবর্তী জীবনেও এর কিছু নেতিবাচক প্রভাব দেখা দিতে পারে। আপনার লেখায় ঠিক এমনি একটি বিষয় উঠে এসেছে- আপনি যখন ১৪/১৫ বছর বয়সী, তখন সমবয়সীদের সাথে মেলামেশার ক্ষেত্রে প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়েছিলেন। বলা চলে আপনি বুলিং (মানসিক, সামাজিক ও সাইবার)– এর শিকারও হয়েছিলেন। ফলে ভীষণ অসম্মানিতবোধ করেছেন। এই নেতিবাচক অভিজ্ঞতা আপনার ভেতরে, নিজের এবং অন্যের সম্পর্কে নেতিবাচক চিন্তা আর অনুভুতির জন্ম দিয়েছে। তখন থেকেই আপনার মধ্যে একধরনের ভয় এবং রাগের জন্ম নেয়, যা এখনও আপনি বহন করছেন। এছাড়াও সেই নেতিবাচক অভিজ্ঞতা আপনার আত্মবিশ্বাস তৈরির পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে তখন থেকে এখন পর্যন্ত একধরনের হীনমন্যতায় ভুগছেন।
তাছাড়া সামাজিক যোগাযোগ দক্ষতা তৈরির ক্ষেত্রেও পরিবার থেকে পর্যাপ্ত সুযোগ পাননি, ফলশ্রুতিতে সামাজিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে আপনি ভীষণ উদ্বিগ্ন বোধ করেন। আপনার ভেতরে এক ধরনের সামাজিক ভীতির জন্ম হয়েছে, যার জন্য আপনি সমবয়সী ছেলেমেয়েদের সাথে মিশতে ভয় পান, তাদের এড়িয়ে চলেন। কিন্তু কিশোর বয়সে বন্ধুবান্ধবির সাথে সুসম্পর্ক থাকলে, একজন মানুষের মনে সাহসের সঞ্চার হয়। আপনার ক্ষেত্রে এই সাপোর্টটি কিছুটা অনুপস্থিত বলে আপনি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। অনুভূতি হচ্ছে নদীর তরঙ্গের মতো- একটা জায়গায় শুরু হয়ে অন্য জায়গায় প্রবাহিত হয়। তেমনি সহপাঠীদের সাথে মেলামেশার ক্ষেত্রে উদ্ভূত ভয় বা নিরাপত্তাহীনতাবোধ এখন অন্য পরিস্থিতিতেও ছড়িয়ে যাচ্ছে (যেমন, রাস্তায় বের হলে পুলিশের ভয়)।
বর্তমানের একটা নেতিবাচক পরিস্থিতি এবং আনুষাঙ্গিক নেতিবাচক অনুভুতি, তার সাথে সম্পর্কিত পূর্বের সব নেতিবাচক অনুভূতিকে নাড়া দেয়। যেমন- বর্তমানে যে চাকরির পরীক্ষায় ফেল করেছেন, এটা আপনার অভিজ্ঞতার অন্য প্রত্যাখ্যাত পরিস্থিতিগুলোকে মনে করিয়ে দেয়। এ জন্যই হয়তবা আপনি আপনার বিষয়গুলো নিয়ে এমুহূর্তে গঠনমূলক কোনো চিন্তা করতে পারছেন না, খুব উদ্বিগ্নতা এবং অস্থিরতায় ভুগছেন, নিজেকে ঘৃণা করছেন এবং নিঃশেষ করতে চাইছেন।
এতকিছুর পরেও আপনার লেখায় কিছু ইতিবাচক বিষয় ফুটে উঠেছে। আপনি লেখাপড়ায় অনেকের চেয়ে এগিয়ে। এর জন্য আপনি অনেকের কাছে সমাদৃতও বটে। সামাজিক যোগাযোগের জন্য নিজে থেকে উদ্যোগী হয়েছেন এবং বন্ধুত্ব গড়ে তুলেছেন। তবে একটি বিষয় লক্ষনীয়, আপনি কোনো ছেলের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠার কথা বলেননি। এছাড়া আপনার পারিবারিক সহযোগিতাও বিদ্যমান। এ প্রত্যেকটি বিষয় কিন্তু আপনার ভেতরে মানসিক শক্তি যোগানের এক একটি উৎস। যদি এই বিষয়গুলোকে নিজের অংশ বলে গ্রহণ করেন এবং ভাবতে পারেন যে আপনি যেমন তেমনভাবেই নিজেকে সম্মান করেন এবং ভালোবাসেন, তাহলে আত্মবিশ্বাস অনেকখানি বেড়ে যাবে। হতে পারে অনেক পরিস্থিতি আপনার অনুকূলে থাকছে না, সফলতা আসছে না বা প্রত্যাশা পূরণ হচ্ছে না, কিন্তু তাই বলে আপনি তো আর পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছেন না। বরং তখনই ভেতরের শক্তিগুলোকে সামনে নিয়ে আসুন এবং সমস্যা সমাধানের অন্য পথগুলো খুঁজে বের করুন। একবার বিফল হলেই কি জীবনের সব পথ বন্ধ হয়ে যায়? ভিন্ন কোনো পথের দেখা হতে পারে যেটা আপনি বর্তমানে দেখতে পারছেন না। কে জানে, হয়ত সেই পথ আপনার প্রত্যাশিত পথের চেয়ে অনেক সুন্দর হবে।
আপনি একাধিকবার রোমান্টিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে চেয়েছেন, যা আপনার বয়সের একটি স্বাভাবিক ধর্ম। তবে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর আপনি প্রচণ্ড হতাশায় ভুগছেন। এক্ষেত্রে বলতে চাই, রোমান্টিক সম্পর্ক তৈরির জন্য আপনার সামনে আরও অনেক সময় পড়ে আছে। এর আগে প্রয়োজন নিজেকে মানসিক এবং সামাজিকভাবে আত্মবিশ্বাসী এবং সাবলম্বী করে গড়ে তোলা।
পরিশেষে বলতে চাই, আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে এবং আপনার মধ্যে যে নেতিবাচক চিন্তা, অনুভূতি কাজ করছে সেগুলো আরো ভালোভাবে বুঝবার ক্ষেত্রে একজন পেশাগত মনোবিজ্ঞানী যেমন, এডুকেশনাল, কাউন্সেলিং বা ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট আপনাকে সহায়তা করতে পারেন।
ভালো থাকুন এবং নিজেকে ভালো রাখতে প্রতিনিয়ত উদ্যোগ গ্রহণ করুন।
ইরফানা সামিয়া
আমি একজন শিক্ষা মনোবিজ্ঞানী এবং সাইকোথেরাপিস্ট। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মনোবিজ্ঞান-এ স্নাতক, পেশাগত শিক্ষা মনোবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর এবং এম ফিল সম্পন্ন করেছি। তাছাড়া ভারত থেকে কাউন্সেলিং বিষয়ে ডিপ্লোমা করেছি। দীর্ঘ ১৩ বছর কাউন্সেলিং পেশার সাথে যুক্ত আছি। বর্তমানে একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে সিনিয়র কাউন্সেলর হিসাবে কাজ করছি।