প্রশ্ন
আমার ছোট বোনের বয়স ২২ বছর। দুই বছর ধরে পারিবারিকভাবে একজনের সাথে বিয়ের কথা হয়। প্রথমে আমার বোন রাজি ছিল না। যাইহোক, ছেলেটা আমাদের পারিবারিকভাবে পরিচিত। এইভাবে আগপিছ করতে করতে দুই বছর কেটে যায়। কোনো এক কারণে বিয়েটা আমাদের পক্ষ থেকে ডিনাই হয়। এখন সমস্যা হচ্ছে, ঐ ছেলে আমার বোনের সাথে গুড রিলেশন রেখে যাচ্ছে। এমন অবস্থায় আমার বোন কোনো কিছুতেই কনসেন্ট্রেট করতে পারছে না।
বিয়ের কথা তো অনেকেই শুনেছে। আমরা তাকে বুঝাচ্ছি বিয়ের কথা হওয়া আর বিয়ে হওয়া আলাদা বিষয়। আর ছেলের সাথে আমার বোনের খুব সিম্পল রিলেশন ছিল । কোনো এফেয়ার ছিল না। প্রবলেমটা হচ্ছে আমার বোনের সাথে বিয়ের পারপাসে ঐ ছেলের সাথে ৩ মাস কথা হয়। তখন মোটামুটি ভাবে দুই ফ্যামিলি সিউর ছিল বিয়েটা হবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিয়েটা হলোনা।
এখন ঐ ছেলে বিয়ের পরও আমার বোনকে নক করছে। আর আমার বোনও তার রেস্পন্স করছে, হাজার নিষেধ করার পরও। এখন কীভাবে আমার বোনকে স্বাভাবিক করা যায়। যদিও ছেলেটার সাথে রিলেশনটাইপ কিছু ছিল না। জাস্ট একধরনের ভালো লাগা হতে যাচ্ছিল। এই বিষয়ে কিছু পরামর্শ চাই। আমরা আর সেই ছেলে এক শহরে থাকি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক
আমাদের পরামর্শ
আপনার প্রশ্ন বিশ্লেষণ করে তার একটি যথাযথ উত্তর দেবার চেষ্টা করছি। বুঝতে পারছি আপনার বোনের বিয়েকে কেন্দ্র করে বর্তমান পারিপার্শ্বিক অবস্থা আপনার ভাবনার উদ্রেক করেছে এবং আপনি আপনার বোনকে এই পরিস্থিতি মোকাবেলা করার ক্ষেত্রে সাহায্য করতে চাচ্ছেন। এই সদিচ্ছার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
আপনি লিখেছেন ঐ ছেলের সাথে আপনার বোনের বিয়ের কথা হচ্ছিল প্রায় দুই বছর ধরে। প্রথমে আপানার বোন এ বিয়েতে রাজি না থাকলেও পরবর্তীতে ছেলের সাথে ফোনের মাধ্যমে এক ধরনের যোগাযোগ তৈরি হয়েছিল। আপনার মতে তাদের ভেতর এক প্রকার ‘সিম্পল রিলেশনশিপ’ ছিল, কোন ভালোবাসার সম্পর্ক ছিল না। তবে কিছুটা ভাল লাগা তৈরি হতে যাচ্ছিল। এমতাবস্থায় কোনো কারণে আপনাদের দিক থেকে বিয়ের আলোচনা ভেঙ্গে দেয়া হয়েছিল। পরবর্তীতে ওই ছেলে অন্যখানে বিয়ে করেছে, কিন্তু তারপরও সে আপনার বোনকে নক করছে, আপনার বোনও তার রেস্পন্স করছে, পরিবারের পক্ষ থেকে নিষেধ করার পরও। এখন আপনার বোন কোনো কিছুতে মনোযোগী হতে পারছেনা। কিভাবে আপনার বোনকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা যায়, আপনি পরামর্শ চেয়েছেন।
[ আরো পড়ুনঃ কোথায় বিনামুল্যে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া যায়?]
আপনার বর্ণিত ঘটনাটির কয়েকটি দিক যদি একটু বিশ্লেষণ করা যায় অথবা কিছু প্রশ্নের উত্তর খোঁজা হয়, তাহলে হয়তবা কিছু দিক নির্দেশনা আপনি পেয়ে যেতে পারেন।
প্রথমত, পরিবার থেকে বিয়ে ঠিক করা হলেও, একজন প্রাপ্তবয়স্ক হিসেবে আপনার বোনের মতামতের যথাযথ গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল কিনা, নাকি তার উপর ওই ছেলের সাথে বিয়ের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিয়ে তাকে জোর করে রাজি করানো হয়েছে? ঠিক একইভাবে বিয়ের কথা ভেঙে দেয়ার ক্ষেত্রে, আপনার বোনের মতামত নেয়া হয়েছিল কিনা? কেননা আমাদের সামাজিক ব্যবস্থায়, বিয়ে একজন মানুষের জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, যার সাথে অনেক আবেগ-অনুভুতি, ভাবনা এবং প্রস্তুতি জড়িত থাকে। আপনার বর্ণনা অনুসারে আপনার বোন প্রথমে রাজী ছিল না। কেন রাজি ছিল না সে বিষয়গুলো লিখলে ভাল হতো। তবে বোঝা যাচ্ছে, সে এই সম্পর্কে প্রবেশের জন্য সম্ভবত প্রস্তুত ছিল না।
ঠিক একইভাবে, সে যখন এই সম্পর্কের দিকে আবেগীয়ভাবে অগ্রসর হওয়া শুরু করেছিল, যেকোনো কারণে অল্প কিছুদিনের মধ্যে তাকে একটা বিচ্ছেদের সম্মুখীন হতে হয়েছে। এখন দেখার বিষয় হচ্ছে, আপনার বোন এই বিচ্ছেদের জন্য প্রস্তুত ছিল কিনা? যদি প্রস্তুতির আগেই সে বিচ্ছেদের সম্মুখীন হয়ে থাকে, তাহলে হয়তবা আপনার বোন একধরনের ‘রিলেশনশিপ ট্রমা’-তে ভুগছে অর্থাৎ সম্পর্ক বিচ্ছেদ জনিত কারণে মানসিকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে। আপনার মতে সেটা ছিল সিম্পল একটা সম্পর্ক, কিন্তু আপনার বোনের মতামত বা অনুভুতি এক্ষেত্রে ভিন্নও হতে পারে। আপনার বোন এই সম্পর্ককে কিভাবে সঙ্গায়িত করছে বা কিভাবে দেখছে সেটা জানা গুরুত্বপূর্ণ।
তাছাড়া যেকোনো বিচ্ছেদ মানুষের মনে কিছু নেতিবাচক আবেগ-অনুভুতির জন্ম দেয়। যথাযথ সময় এবং পারিপার্শ্বিকতা একজন মানুষকে ওই নেতিবাচক আবেগ/অনুভুতি কাটিয়ে উঠতে সহায়তা করে। এক্ষেত্রে পরিবারের সদস্যদের ভূমিকা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। তাই আপনার বোনকে বকাঝকা /কটূক্তি না করে, তার মানসিক এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থার প্রতি সহমর্মী হতে হবে। বোনের বিয়ে নিয়ে পরিবারের সিদ্ধান্তে যদি কোনো অসঙ্গতি থেকে থাকে, সেটা স্বীকার করলে এবং তার জন্য দুঃখ প্রকাশ করলে, কিছুটা হলেও আপনার বোন ভাল অনুভব করবে।
বিয়ের কথা ভেঙে দেয়ার কারণ সম্পর্কে আপনি কিছু লেখেননি। বিয়ের আলোচনা ভাঙার যৌক্তিক কারণগুলো যদি তার সাথে খোলামেলা আলোচনা করা হয়, সে নিশ্চয়ই বুঝতে পারবে। কিন্তু তার অনুভুতির কথাগুলো আগে আপনাদের মনোযোগ দিয়ে শুনতে হবে। মনের ভেতর জমে থাকা নেতিবাচক আবেগ মানুষের আচরণকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করে, যৌক্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে বাঁধা প্রদান করে।
পরিবারে যার সাথে আপনার বোন তার মনের কথা নির্দ্বিধায় বলতে পারে, তাকে এগিয়ে আসতে হবে। আপনার বোনের অনুভুতির প্রতি শ্রদ্ধা ও সহমর্মিতা প্রকাশ করতে হবে। এক্ষেত্রে আপনার বোন একজন মনোবিজ্ঞানি/কাউন্সেলরের সহায়তাও গ্রহণ করতে পারেন।
আপনি আরও লিখেছেন, ওই ছেলেটি আপনার বোনের সাথে ‘গুড রিলেশন’ রেখে যাচ্ছে। এখানে ‘গুড রিলেশন’ বলতে কি বোঝাতে চেয়েছেন, তা আরেকটু জানালে ভাল হতো। এটা যদি সুস্থ এবং সুন্দর একটা বন্ধুত্ব হয়, তাহলে সেটা সবার জন্য ভাল হয় কিনা সেটা ভেবে দেখা যেতে পারে।
আরেকটি বিষয়, আপনার বোনের শিক্ষাগত যোগ্যতা কি বা সে কোন চাকুরী করছে কিনা- উল্লেখ করা হয়নি। আমার মতে ২২ বছর বয়সে বিয়ে ছাড়াও আরও কিছু বিষয়ের উপর জোর দেয়া যেতে পারে, যেমন শিক্ষাগত এবং পেশাগত দক্ষতা অর্জন। এই বিষয়গুলো একজন মানুষকে স্বাবলম্বী এবং আত্মবিশ্বাসী হতে শেখায়। জীবনের প্রতিকূলতাকে মোকাবেলা করতে শেখায়। জীবন মানে তো আর থেমে থাকা নয়, এগিয়ে চলা নদীর বহমান স্রোতের মত…… ঝর-বৃষ্টি-জোয়ারভাটায় প্রতিনিয়ত যার রূপ বদলায়!
অনেক শুভ কামনা রইল।
ইরফানা সামিয়া
আমি একজন শিক্ষা মনোবিজ্ঞানী এবং সাইকোথেরাপিস্ট। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মনোবিজ্ঞান-এ স্নাতক, পেশাগত শিক্ষা মনোবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর এবং এম ফিল সম্পন্ন করেছি। তাছাড়া ভারত থেকে কাউন্সেলিং বিষয়ে ডিপ্লোমা করেছি। দীর্ঘ ১৩ বছর কাউন্সেলিং পেশার সাথে যুক্ত আছি। বর্তমানে একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে সিনিয়র কাউন্সেলর হিসাবে কাজ করছি।