“ও আমার পাগলা ঘোড়া রে
কৈ থাইকা কৈ লইয়া যাস
যখন তখন আমারে দিয়া কাটাইয়া নেস ঘাস
আমার পাগলা ঘোরা রে…”।
আমাদের প্রত্যেকের ভেতরে একটি শিশু সত্তা থাকে। সমস্ত আবেগ অনূভূতির মূলে রয়েছে এই শিশু। আর আমাদের ভেতরের সেই শিশুটিকেই এই গানে পাগলা ঘোড়া আখ্যা দেওয়া হয়েছে।
যাই ঘটুক না কেন আমরা চাই নিজের উপর বা ওই পাগলা ঘোড়ার উপর নিয়ন্ত্রণ। মানে ঘুরে ফিরে ওই আবেগের উপরই নিয়ন্ত্রণ। যার বশবর্তি হয়ে আমরা যা তা করে বসি। মানসিক স্বাস্থ্যে নিয়ন্ত্রণ শব্দটি যথাযথ জায়গা না পেলেও, ম্যানেজমেন্ট বা ব্যবস্থাপনা খুবই উপযুক্ত একটি শব্দ। পার্থক্য এই যে নিয়ন্ত্রণ হল দমন করা। অন্যদিকে ব্যবস্থাপনা বেশ ইতিবাচক একটি শব্দ। নিজেকে বা নিজের আবেগ-অনুভূতিকে দমন করে কখনও সত্যিকার অর্থে সমস্যার সমাধান করা যায় না বরং তা আরও ভয়ঙ্কর বিপদ ডেকে আনতে পারে। অর্থাৎ আপনার ভেতরের শিশুটির দমন নয় বরং ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন। আর এই ব্যবস্থাপনার জন্য সবার আগে জানা দরকার আবেগ-অনুভূতি কি, আর কেমন তার গতিপ্রকৃতি।
হয়ত ভাবছেন, আবেগ-অনুভূতিকে আবার নতুন করে জানার কি আছে? এ আর এমন কি? কিন্তু সত্যটি হলো, আমরা বেশিরভাগ মানুষই আবেগ-অনুভূতি সম্পর্কে কিছু ভুল ধারনা পোষণ করি। আবেগ-অনুভূতিকে অন্য অনেক কিছুর সাথে গুলিয়ে ফেলি। তেমনই কিছু মিথ বা ভুল ধারনা নিচে তুলে ধরা হল।
ভুল ধারনাঃ কিছু অনুভূতি ভাল আর কিছু অনুভূতি মন্দ
সঠিকঃ অনুভূতির রকমফের আছে কিন্তু ভাল-মন্দ নেই। প্রত্যেকটি অনুভূতিই গুরুত্বপূর্ন। দুঃখ, হতাশা, ভয়, রাগ, হিংসা এই ধরনের অনুভূতিগুলোর সাথে মোকাবেলা করা কঠিন, কিন্তু তার মানে এই নয় যে এগুলো মন্দ বা খারাপ। বিভিন্ন পরিস্থিতিতে এই ধরনের অনুভূতিগুলো আমাদেরকে জানান দেয় যে কিছু একটা গোলমাল আছে, পরিবর্তন দরকার। যেমন, পরীক্ষা খারাপ হলে আমরা হতাশায় ভুগি, ফলে বুঝতে পারি আরও পড়ালেখা বা পরিশ্রম দরকার।
ভুল ধারনাঃ আবেগ-অনুভূতিকে নিয়ন্ত্রণ করা বা দমিয়ে রাখা উচিত
সঠিকঃ আবেগ-অনুভূতিকে দমিয়ে রাখলে বা নিয়ন্ত্রণ করলে তা আরও ভয়াবহ শারীরিক বা মানসিক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। তাই নিয়ন্ত্রন বা দমন নয় বরং যথাযথ ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন (আবেগ-অনুভূতির ব্যবস্থাপনা থাকবে পরবর্তী পর্বগুলোতে)।
ভুল ধারনাঃ আমাদের সব সময়ই সুখী থাকা উচিত
সঠিকঃ আমরা দিনরাত ২৪ ঘন্টাই সুখী থাকব এমন প্রত্যাশা অবাস্তব। অন্যান্য অনুভূতিগুলোর মতই সুখ একটি অনুভূতি মাত্র। গবেষণায় দেখা গেছে যারা সবসময় সুখ, শান্তি বা আনন্দ অনুভব করার জন্য অন্যান্য আবেগগুলোকে দমিয়ে রাখে বা অস্বীকার করে তারা পরবর্তীতে বিভিন্ন রকম শারীরিক ও মানসিক সমস্যায় ভোগে। অন্যদিকে যারা সুখের পাশাপাশি কষ্টকর বা অস্বস্তিকর আবেগগুলোকেও নিজের ভেতর জায়গা দেয়, অর্থাৎ দমিয়ে না রেখে তাদের অস্তিত্ব স্বীকার করে এবং যথাযথ ব্যবস্থাপনা করে, তারা কর্মদীপ্ত ও বর্ণাঢ্য জীবনযাপন করে।
ভুল ধারনাঃ আবেগপ্রবণ হওয়া দুর্বলতার লক্ষণ
সঠিকঃ আপনার আবেগগুলোই আপনার শক্তি। বিভিন্ন সময়ের অনুভূতিগুলোকে অনুভব করতে পারা দুর্বলতা নয় বরং সবলতার লক্ষণ। আপনি আপনার অনুভূতিগুলোকে অনুভব করছেন মানে আপনি নিজের সাথে সংযুক্ত। নিজের ইচ্ছে ও অনুভূতি বুঝতে পারা আবেগীয় বুদ্ধিতার লক্ষণ।
ভুল ধারনাঃ অনুভূতিগুলো স্থায়ী; যে যেমন অনুভব করে, সে সবসময় তেমনটাই অনুভব করে
সঠিকঃ ভাগ্যিস তা নয়! অর্থাৎ অনুভূতিগুলো পরিবর্তনশীল। একজন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন কারণে, বিভিন্ন রকম অনুভূতি অনুভব করে। পার্থক্য এখানেই, কেউ বুঝতে পারে কেউ পারেনা। বরং দীর্ঘদিন একই রকম অনুভূতি অনুভব করা মানসিক রোগের লক্ষণ। যেমন, বিষণ্ণতার (মেজর ডিপ্রেশন) রোগীরা দীর্ঘদিনযাবত বিরামহীনভাবে বিমর্ষ থাকে, সুখ বা আনন্দের পরিস্থিতিতেও তারা সুখ অনুভব করতে পারে না। আবার বায়পোলার ডিসঅর্ডারের ম্যানিক এপিসোডে রোগীরা প্রচণ্ড ফুর্তিতে বা আনন্দে থাকে। তেমনি, উদ্বেগজনিত রোগে ভুক্তভোগীরা অধিকাংশ সময়ই অস্থির এবং দুশ্চিন্তাগ্রস্থ থাকে। এজন্যই এগুলোকে এবনরমাল সাইকোলজির আওতাভুক্ত করা হয়েছে।
ভুল ধারনাঃ আমি কখন কি অনুভব করব তা আমার নিজের হাতে নেই
সঠিকঃ বিভিন্ন পরিস্থিতিতে আমাদের বিভিন্ন রকম অনুভূতি হয়, তার মানে এই নয় যে সেটাই চরম ও চুড়ান্ত অনুভূতি। আমরা চাইলে আমাদের অনুভূতিগুলোকে চিহ্নিত করে তার যথাযথ ব্যবস্থাপনা যেমন করতে পারি, তেমনি বিভিন্ন পরিস্থিতি তৈরি করে নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী অনুভূতি সৃষ্টি করতে পারি। যেমন, বিপদ্গ্রস্থ মানুষের পাশে দাঁড়ালে যাদের প্রশান্তির অনুভূতি হয়, প্রশান্তির জন্য তারা তা করতে পারে। আবার রকিং চেয়ারে দুলে দুলে গান শুনলে যাদের রিল্যাক্স লাগে, রিল্যাকজেশনের জন্য তারা তা করতে পারে। তেমনি প্রকৃতির ছোঁয়ায় কেউ যদি আনন্দে আত্মহারা হয় তাহলে আনন্দের খোঁজে নিশ্চয়ই তারা প্রকৃতির মাঝে বিচরণ করতে পারে।
আবেগীয় বুদ্ধি বাড়ানোর প্রথম ধাপ হল আত্মসচেতনতা। আর আবেগ-অনুভূতি সম্পর্কে বিভিন্ন ভুল ধারনা আত্মসচেতনতার পথে বড় বাধা। এই পর্বে তার অবসান ঘটল! এরপর অর্থাৎ তৃতীয় পর্বে থাকছে অনুভূতিকে চিনতে পারার নানা কলাকৌশল। পড়তে থাকুন।
রাউফুন নাহার
রাউফুন নাহার মাস্টার্স করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশনাল অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগ থেকে এবং অনার্স করেছেন একই বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগ থেকে। বর্তমানে এডুকেশনাল এন্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগে প্রভাষক হিসেবে কর্মরত আছেন। ভালোবাসেন মানুষ, প্রকৃতি আর তাদের ভেতরের অন্তর্নিহিত সুরকে।
- রাউফুন নাহার#molongui-disabled-link
- রাউফুন নাহার#molongui-disabled-link
- রাউফুন নাহার#molongui-disabled-link
- রাউফুন নাহার#molongui-disabled-link