আমার বয়স ১৭। আমার আম্মু ছোটবেলা থেকেই আমাকে কেমন যেনো সহ্য করতে পারেন না। আমার নিজের মা যে কতো সময় আমার সাথে ভালো করে কথা বলেছে তা আমি গুনে গুনে বলতে পারি। আম্মু আমার ছোটখাটো ভুলগুলোকেই অনেক বড় করে দেখেন এবং মনে করেন যে এর জন্য উপযুক্ত গুরুতর শাস্তি না দিলে এই ভুল শুধরাবে না। তার অনেক ফল ভুগতে হয়েছে, এমনকি এখনো হচ্ছে।
আব্বু চাকরি করেন, তাই সেই সকালে চলে যান, রাতে আসেন। আমার দিক খেয়াল করার সুযোগ পান না। আর আব্বু যতসময় বাসায় থাকেন আম্মুর সাথে ঝগড়া চলতেই থাকে প্রায় সময়, তার প্রভাব পড়ে আমার উপরে। আব্বুকে কখনো আম্মুর ব্যাপারে বলার সাহস পাইনি ছোটবেলায়, কারণ আব্বুকে বললে তিনি আম্মুকে কিছু বলবে, আর আম্মু আমার ওপর আরো রেগে যাবে।
একটা উদাহরণ দিই, তখন আমি খুব ছোট। আমার হাত থেকে একটা পানির গ্লাস পড়ে যাওয়ায় আম্মু আমাকে খুব মেরেছিল, আবার একটা অন্ধকার রুমে অনেক সময় আটকে রেখেছিল। মোটকথা সে আমাকে গালাগাল না দিয়ে কথাই বলতে পারে না। আবার ধরা যাক কোনো রিলেটিভের বাসায় গেছি আমরা, আম্মু সবার সামনে খুব ভালো করে কথা বলছে, আড়ালে আমার ত্রুটি ধরে বকা দিচ্ছে। আমি যখন স্কুলে পড়তাম, আমার হাতে পায়ে অনেক দাগ থাকত। সবাই ভাবত আমারই কোনো সমস্যা আছে, যার জন্য এমনটা। এই নিয়ে আরো বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে যেতাম আমি। স্টুডেন্ট হিসেবে খুব ভাল না হলেও মোটামুটি, কিন্তু তারপরও আশানুরূপ রেজাল্ট হয় না। আমার রেজাল্ট নিয়ে আমার চাইতে আমার আম্মুকে বেশি তোড়জোড় করতে দেখা গেলেও ভিতরে আমার খারাপ লাগাটাই বেশি কাজ করে।
মোটকথা আমার নিজের মা আমাকে সবচাইতে বেশি কষ্ট দেয়। আমার মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় আমি মরে যাই। মাঝে মাঝে বললে ভুল হবে, প্রতিনিয়ত মনে হয়। এখন হয়তো গায়ে হাত তুলে না, কিন্তু তার একেকটা কথা, তার ব্যবহারে আমি খুব কষ্ট পাই। ডিপ্রেশনে চলে যাই। হয়তো এভাবেই কোনোদিন কোনো কিছু করে ফেলব। আমার মনে হয় আমার আম্মুর মানসিকভাবে কোনো সমস্যা আছে। কিন্তু আমাকে সহ্য করতে না পারা ছাড়া বাইরে তা প্রকাশ পায় না বলে কেউ বিশ্বাস করতে চায় না।
আচ্ছা এর কি কোনোই সমাধান নেই? এভাবেই কি একদিন মরে যেতে হবে? স্বাভাবিক জীবনে কি এভাবে বেঁচে থাকা সম্ভব?
আমাদের পরামর্শ
প্রথমে তোমাকে ধন্যবাদ জানাই, তুমি তোমার মনের কথাগুলো এত সুন্দরভাবে গুছিয়ে লিখেছ। মায়ের সাথে খারাপ সম্পর্ক খুব দুঃখজনক একটা ব্যাপার। তোমার লেখা পড়ে মনে হচ্ছে তুমি তোমার শৈশব এবং কৈশোর (বর্তমান সময়টা) স্বাচ্ছন্দে কাটাতে পারনি এবং এখনও পারছ না। এর জন্য খারাপ বোধ করছি। তোমার লেখায় দুইটি বিষয় আছে। আমি সেই আলোকে কিছু আলোচনা করছি।
প্রথমত, তোমার মা-বাবা’র নিজেদের মধ্যে সম্পর্ক ভালো নেই। তারা প্রায় সময় ঝগড়া করেন। দেখা গেছে, অনেক সন্তান তাদের বাবা-মায়ের মধ্যে ঝগড়ার কারণ হিসেবে নিজেকে দোষারোপ করে। এই ঝগড়ায় সন্তান হিসেবে তার কোন কিছু করার নেই তা বুঝে উঠতে বেশ সময় লেগে যায়। নিজেকে দায়ি ভাবতে ভাবতে অনেক সময় বাচ্চারা নিজের ক্ষতি করারও (যেমন, হাত কাটা, মরে যাওয়া ইচ্ছা) চেষ্টা করে।
তোমার মধ্যে এরকম কোনো চিন্তা কাজ করছে কি না, ভেবে দেখতে পারো। তোমার মা-বাবার নিজেদের মধ্যকার সম্পর্কের জন্য তোমার কি করার আছে, তাও খতিয়ে দেখতে পারো। যদি তেমন কিছু করার না থাকে, তাহলে অবশ্যই তোমার নিজেকে দোষারোপ করা হয়ত ঠিক হবে না।
দ্বিতীয়ত, তুমি ঠিক ধরেছ, তোমার মা নিজেও হয়ত কোনো মানসিক স্বাস্থ্যজনিত অসুবিধায় আছেন, অথচ কাউকে বলছেন না অথবা বলতে পারছেন না। এরকমও হতে পারে, তিনি জানেনই না মানসিক অসুবিধায় পড়লে কি করতে হয় (আপনি যেমন, আমাদের লিখেছেন।) তোমার মায়ের হয়ত দীর্ঘদিনের কোনো কষ্ট আছে, তিনি হয়ত নিজেও অসহায় বোধ করেন অথবা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন। এরকম মানসিক অবস্থায় থাকা মানুষ সাধারণত অন্যের সাথেও খিটখিটে আচরণ করে থাকেন।
তুমি তোমার মায়ের কাছে, যখন ভালো মেজাজে থাকেন তখন, জানতে চাইতে পারো- “মা, তুমি কেমন আছো?” “তোমার কেমন লাগছে?” “তোমার কি কোনো কষ্ট আছে?” “তুমি চাইলে আমার কাছে খুলে বলতে পারো।”
যেহেতু এখন তোমার বয়স ১৭, তুমি চাইলে তোমার মায়ের বন্ধু হতে পারো। আগে থেকেই নেতিবাচক ধারণা না রেখে, খোলামনে মায়ের সাথে আলাপ করে দেখো।
এছাড়াও তুমি সরাসরি একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সাথেও কথা বলতে পারো, যেহেতু তুমি বিষণ্নতার লক্ষণ অনুভব করছ। এছাড়াও অনেকবেশি একাকী এবং অসহায়বোধ হলে সরাসরি কোনো কাউন্সেলরের সাথে কথা বলতে পারো।
আমাদের চারপাশের অনেককিছুর ওপর আমাদের একেবারেই নিয়ন্ত্রণ থাকে না (যেমন, তোমার মা-বাবা’র দাম্পত্য সম্পর্ক) কিন্তু সেগুলো আমাদের ভালো থাকাকে অনেক প্রভাবিত করে।
সেক্ষেত্রে, ধীরস্থির হয়ে পরিস্থিতি মোকাবেলা করার দৃঢ় মনবল তৈরি করতে হয়।
তোমার শখ, আগ্রহ বা জীবন পরিকল্পনা কী, সেগুলো নিয়ে কিছু জানাওনি। এসব বিষয় নিয়ে ভাবতে পারো। ছোটো ছোটো করে কিছু উদ্যোগ নিতে পারো। তোমার সমস্যা হয়ত দ্রুত সমাধান হবে না, কিন্তু তুমি সমস্যাগুলো এক পার্শ্বে রেখে, তোমার নিজের জন্য স্বস্তিদায়ক কিছু করতে পারো।
তোমার জন্য অনেক অনেক শুভকামনা।
মরিয়ম সুলতানা সুরভি
সাইকোলজিক্যাল কাউন্সিলর,
সাইকোলজিক্যাল হেলথ এন্ড ওয়েলনেস ক্লিনিক (পি এইচ ডাব্লিউ সি)