Self care during Covid-19 Pandemic

মনোবিজ্ঞানীদের মানসিক সুস্থতা যেভাবে

করোনা ভাইরাস ডিজিজ ২০১৯ (কোভিড-১৯) রোগটিকে “বিশ্ব মহামারী” হিসেবে ঘোষণা করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। করোনা এমন একটি সংক্রামক ভাইরাস যা মানুষের ফুসফুসে সংক্রমণ ঘটায় এবং শ্বাসতন্ত্রের মাধ্যমে একজনের দেহ থেকে আরেকজনের দেহে ছড়ায়।

সারাবিশ্বের মতো বাংলাদেশেও করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকজন করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত করা হয়েছে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা ভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে লোকজনকে সমাজের আর সকলের কাছ থেকে নিজেদের নির্দিষ্ট দূরত্ব (Social distance) বজায় রেখে চলতে হবে। আমরা যারা মনোবিজ্ঞানী, মানুষের অনুভূতি নিয়ে কাজ করি, আমরাও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছি সবার থেকে। মহামারীর বিস্তারকে ধীর বা থামিয়ে দিতে এই সময়ে সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন হওয়া খুবই জরুরি। তবে এই বিচ্ছিন্নতার ফলে মানসিক স্বাস্থ্য ঝুঁকিও রয়েছে। 

মহামারীর এই সময়ে কিছুটা উদ্বিগ্ন হওয়াটা প্রয়োজনীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ – যেমন বারবার খেয়াল করে হাত ধোয়া, হাত চোখে মুখে না দেয়া এবং অন্যদের থেকে নিজেকে দূরে রাখা। কিন্তু মাত্রাতিরিক্ত উদ্বেগ আমাদের জন্য ক্ষতিকর যা বিপর্যয় ঘটায়। আমরা যত বেশি উদ্বিগ্ন হই, ততই কিছু তথ্য দিয়ে আমাদের উদ্বেগকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করি। সর্বশেষ আপডেটের জন্য আমাদের চোখ মোবাইলের স্ক্রীনে আটকে থাকে। প্রতিদিন একটি আপডেট অর্থবহ। তবে প্রতি মুহূর্তে স্ক্রীনে নিউজগুলিকে চেক করা ঝুঁকিপূর্ণ, যেটা অস্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়ার মতো। এরকম ভার্চুয়াল অস্বাস্থ্যকর খাবার দিয়ে আমাদের মন ভরে উঠছে যা এক সময় আমাদের অসুস্থ করে তুলবে। 

সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাস সম্পর্কে অবিরাম কথাবার্তা আমাদের ভয় ও উদ্বেগকে আরো বাড়িয়ে তুলতে পারে। প্রচুর ভুল এবং অবৈজ্ঞানিক তথ্যও সোশ্যাল মিডিয়াতে হরহামেশাই প্রচারিত হচ্ছে। তাই আমাদের উচিত বারবার সোশ্যাল মিডিয়া চেক না করে বিশ্বাসযোগ্য উৎস যেমনঃ রোগতত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) বা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডাব্লুএইচও)– এর মতো উৎস হতে খবর সন্ধান করা ।

মনোবিজ্ঞানী হিসেবে আমরা যা পারব না তার পরিবর্তে, আমরা কী নিয়ন্ত্রণ করতে পারব সেদিকে আমাদের মনোনিবেশ করা দরকার । অপ্রত্যাশিত এই বিচ্ছিনতার সময়কে বিভিন্ন কাজে লাগানো দরকার যাতে আমরা শারীরিক সুস্থতার পাশাপাশি মানসিকভাবে সুস্থ থাকতে পারি। এই অবসরে বাসায় বসে কী করতে পারেন তার কিছু ধারণা দিতেই এই লেখা। 

এক) বই পড়া

বিভিন্ন প্রশিক্ষণে আমাদের অনেক বই কেনা হয় যেগুলো পড়ার সুযোগ খুব কমই হয়।  এই সময়ে আমরা সেই বইগুলো বুঝে বুঝে পড়া শুরু করতে পারি। তাছাড়া মাত্রই একুশে বইমেলা শেষ হয়েছে, মেলা থেকে কেনা বইগুলোও আমরা পড়া শুরু করতে পারি।

দুই) গবেষণা প্রকাশে উদ্যোগী হওয়া 

আমরা সবাই স্নাতক বা স্নাতকোত্তর পর্যায়ে গবেষণা প্রজেক্ট করেছি, যেগুলো থেকে গবেষণা প্রবন্ধ লিখা এবং জার্নালে প্রকাশের উদ্যোগ নিতে পারি। সময়ের অভাবে এতদিন হয়ত আমরা তা করতে পারি নি। এই সময়টাতে পরিকল্পনা করে থিসিস রিপোর্টগুলো ঘষামাজা করে জার্নাল আর্টিক্যাল আকারে প্রকাশ করার কাজটা সেরে ফেলতে পারি। এই সময়ে অন্তত একটা আর্টিক্যাল প্রকাশ করতে পারলেও তা ক্যারিয়ারের জন্য খুবই ইতিবাচক হিসেবে বিবেচিত হবে।  

তিন) বাগান করা

সবুজ গাছপালার মাঝে সময় কাটালে মন শান্ত ও প্রস্ফুটিত হয়। বারান্দায় বা ছাঁদে বাগান করার জন্য নানাবিধ আইডিয়া খুঁজে পাওয়া যাবে অনলাইনে। বাগান করার জন্য বসন্তকাল উপযুক্ত সময়। এই সময়ে বাগান করে বিচ্ছিন্নতার মানসিক চাপ উপশম করা যেতে পারে।

চার) মুভি দেখা

প্রিয় মুভিগুলোর তালিকা করে এই সময়ে একটা একটা করে দেখা যায়। সাইকোলজি সম্পর্কিত মুভিগুলোও তালিকায় রাখা যেতে পারে।

পাঁচ) লেখালেখি করা

আমাদের অনেকেরই লেখালিখি করার ইচ্ছা থাকে কিন্তু শুরু করব করব করে আর হয়ে ওঠে না। সাইকোলজির বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আমরা লেখা শুরু করতে পারি। সংবাদপত্র অথবা অনলাইন পোর্টাল যেমন মনোযোগী মন-এ সেগুলো প্রকাশও করতে পারি। 

ছয়) নতুন ওয়ার্কশপের ডিজাইন করা

এই সময়ে নতুন কিছু ওয়ার্কশপের ডিজাইন করতে পারি যা পরবর্তীতে অবস্থার উন্নতি হলে সরাসরি করানো যেতে পারে। 

সাত) নতুন কিছু রান্না করা

রান্নাঘরে মনোযোগী সময় ব্যয় করলে মানসিক চাপ এবং অস্থিরতা কমে আসে। ইউটিউব দেখে আমরা নতুন নতুন খাবারের রেসিপি  তৈরি করতে পারি। পরিবারের সদস্যরা নিশ্চয় অবাক হবেন! 

আট) ঘরবাড়ি পরিষ্কার করা

নিজের কাজ নিজে করা একটি সাঙ্ঘাতিক গুরুত্বপূর্ণ জীবন দক্ষতা। এই বাড়তি সময়ে নিজের প্রয়োজনীয় কাজ যেমন নিজের থাকার জায়গা আমরা নিজেরাই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে পারি। পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা পরিবেশের উপর নিয়ন্ত্রণ অর্জনে আমাদের সাহায্য করে যা মানসিক স্বাস্থ্যের উপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।  ঘরের আসবাবপত্র নতুনভাবে সাজিয়ে ঘরের সৌন্দর্য্যের পরিবর্তন করা যেতে পারে।

নয়) শখ পূরণ করা

আমরা যা করতে উপভোগ করি তাতে সময় ব্যয় করে আমাদের মানসিক স্বাস্থ্য এবং সুস্থতার উন্নতি করতে পারি। সেলাই করা, ছবি আঁকা, নতুন ভাষা শেখা ইত্যাদি কাজ এই অবসরে করা যেতে পারে। ইদানিং অনলাইনে বিভিন্ন ধরনের কোর্স বিনামূল্যে করানো হয়। এই সময়ে আপনার প্রয়োজনীয় কোনো কোর্স করে আপনার দক্ষতার ঝুঁলি আরেকটু সমৃদ্ধ করে নিতে পারেন। 

দশ) যোগ ব্যায়াম করা

মনোবিজ্ঞানী হিসেবে আমরা জানি যে যোগ ব্যায়াম হতাশা এবং উদ্বেগ কমাতে দারুণ কার্যকর উপায়। যোগ ব্যায়াম সচেতনতা বৃদ্ধি করে, মানসিক চাপ উপশম করে, মনোযোগ বৃদ্ধি করে এবং স্নায়ুতন্ত্রকে শান্ত করে। আমরা ক্লায়েন্টদের যোগ ব্যায়াম করতে উৎসাহিত করে, কিন্তু সচরাচর আমাদের করা হয়ে ওঠে না। এই সময়ে ঘরে থেকে যোগ ব্যায়ামের নানা অনুশীলন করতে পারি।

এগার) পরিবারের সাথে সময় কাটানো

অনেক মনোবিজ্ঞানীর মধ্যে একটা আফসোস থাকে যে আমি দিন শেষে পরিবারকে যথেষ্ট সময় দিতে পারি না। ছুটির দিনগুলোতেও দেখা যায় বিভিন্ন ধরনের ট্রেনিং, ওয়ার্কশপ ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয়। এবার যেহেতু একটা সুযোগ পাওয়া গেছে তাই পরিবারের সদস্যদের যথেষ্ট সময় দিন। তাদের সাথে অন্তরঙ্গ সময় কাটান।

এই সময়ে প্রচুর তরল পান করুন, বিশ্রাম নিন এবং পর্যাপ্ত ঘুমান। ঠান্ডার উপসর্গ স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি বলে মনে হলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন। সচেতন থাকাটাই মূল বিষয়। আপনি মানুষের জন্য অনেক কিছু করছেন বা করবেন বলে মনস্থির করেছেন, তার জন্য আপনার নিজেকে সুস্থ সবল থাকা জরুরি। কারণ আপনি মানসিকভাবে সুস্থ থাকলে দেশের কিছু মানুষ মানসিকভাবে সুস্থ থাকবে।

Mostak Ahmed Imran
মোস্তাক আহমেদ ইমরান
mostak.ahamed.imran@gmail.com | + posts

অ্যাসিস্ট্যান্ট এডুকেশনাল সাইকোলজিস্ট এন্ড প্লে থেরাপিস্ট,

সদস্য, বিট্রিশ এসোসিয়েশান অফ প্লে থেরাপিস্ট (বেপ্ট)

সাইকোলজিক্যাল সার্ভিস সেন্টার

এডুকেশনাল এন্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Post Author: মোস্তাক আহমেদ ইমরান

অ্যাসিস্ট্যান্ট এডুকেশনাল সাইকোলজিস্ট এন্ড প্লে থেরাপিস্ট, সদস্য, বিট্রিশ এসোসিয়েশান অফ প্লে থেরাপিস্ট (বেপ্ট) সাইকোলজিক্যাল সার্ভিস সেন্টার এডুকেশনাল এন্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।