আস্সালামু আলাইকুম। আমি একজন সরকারি চাকুরীজীবি। আমার দু‘টি সন্তান। বড় ছেলে সন্তান- বয়স ১৭ বৎসর, কলেজে পড়ে। পড়াশুনায় ভালো। ছোট মেয়ে সন্তান যার বয়স ১২ বৎসর। এ বছর মে মাসে আমরা ছেলেকে নটরডেম কলেজে ভর্তি করি। সে নিয়মিত মোহাম্মদপুর হতে কলেজে আসা-যাওয়া করে। এর বাইরে সে নিয়মিত প্রাইভেট কোচিং করে।
আমরা বাবা-মা কিছুদিন পূর্বে অনুধাবন করি যে আমার ছেলেটি একটি মেয়ের প্রেমে পড়েছে। মেয়েটি তার ক্লাসমেট এবং অত্র এলাকার অন্য একটি কলেজে পড়ে। প্রাইভেট পড়ার সুবাদে কোন একটি কোচিং সেন্টার হতে হয়ত এর সূচনা। প্রেমে জড়িয়ে পড়ার বিষয়টি ছেলের মা তার সাথে বলে নিশ্চিত হয়। ছেলের দৈনন্দিন আচরণে লক্ষ্য করা যায়, সে প্রায়শই কারো সাথে মোবাইলে চেটিং করে এবং হয়ত মেয়েটির সাথে কদাচিৎ ডেটিংও করে । বয়স অনুযায়ী নৈতিক অবস্থান, পড়াশুনা ও সার্বিক শারীরিক/মানসিক স্বাস্থ্যের বিবেচনায় আমরা তাকে সে অবস্থা হতে সরে আসার অনুরোধ করি এবং জীবন সম্পৃক্ত নানাবিধ পরামর্শ দেই । এটি বেদনাদায়ক হলেও সত্য যে আমার সন্তান এখনও সম্পর্কটি বজায় রেখেছে এবং উপরন্তু তার মাকে এই সম্পর্কের পক্ষে ছফাই গাইছে। একটি পর্যায়ে তাকে নিয়ন্ত্রনের জন্য আমি তার সেলুলার ফোনটি নিয়ে নেই। এতে সে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠে । আলোচ্য ইস্যুত সন্তানের সাথে আমাদের সম্পর্ক ধীরেধীরে অবনতির দিকে যাচ্ছে । আমরা অত্যন্ত মনোবেদনায় দিন কাটাচ্ছি । পুরো বিষয়টির একটি সুন্দর সমাধান প্রয়োজন। আমরা আপনার/আপনাদের সদয় জ্ঞানগর্ভ পরামর্শ /দিকনির্দেশনা কামনা করছি। ধন্যবাদ।
আমাদের পরামর্শ
ওয়ালাইকুম আসসালাম। ধন্যবাদ, আপনার বর্তমান মনোবেদনায় সহযোগী হিসেবে মনোযোগী মন-কে বিবেচনা করার জন্য।
আপনার লেখা থেকে বোঝা যাচ্ছে আপনি বাবা হিসেবে সন্তাদের খুবই ভালবাসেন এবং তাদের সার্বিক দেখাশোনার ব্যাপারটিকে শত ব্যস্ততার মাঝেও প্রাধান্য দেন যা খুবই ইতিবাচক।
আপনারা অনুধাবন করেছেন এবং নিশ্চিত হয়েছেন যে, আপনার ছেলে একটি প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়েছে। এই সম্পর্ক জড়ানোতে আপনি কি অসুবিধার আশঙ্কা করছেন তা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেন নি। তবে যতটুকু বোঝা যাচ্ছে, আপনি হয়ত আপনার সন্তানের শিক্ষা জীবনে মনঃসংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়া এবং তার ভবিষ্যতের লক্ষ্য অর্জনের অন্তরায় হিসেবে এই প্রেমের সম্পর্কটিকে বিবেচনা করছেন।
এখানে কিছু বিষয়ের উপর গুরুত্বারোপ করে পরামর্শ প্রদানের চেষ্টা করব।
আপনার ছেলের বয়স (১৭) বলছে সে একজন কিশোর। এই বয়সে নতুন সম্পর্ক তৈরি করা একটি বিকাশজনিত চাহিদা (Developmental Need) যা একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়াও বটে। কিশোর বয়সে ছেলেমেয়েরা নিজেদের একটি পরিচয় খোঁজার আপ্রাণ চেষ্টা করে। এই আত্মপরিচয় খোঁজা এবং ভালোভাবে তা গড়ে উঠার প্রক্রিয়ায় সম্পর্ক তৈরি করাকে একটি মাপকাঠি হিসেবে অনেকসময় বিবেচনা করে। এর মাধ্যমে তারা নিজেদের যোগ্যতার একটা স্তর বোঝার চেষ্টা করে। তাই, এই বয়সে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ এবং সম্পর্ক জড়ানোর ব্যাপারটিকে স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আপনি আপনার সন্তানের বিজ্ঞানসম্মত বিকাশজনিত চাহিদা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন না। আপনি জানিয়েছেন তাকে নিয়ন্ত্রণ করবার জন্য তার ফোনটি নিয়ে নিয়েছেন যা পরিস্থিতি এবং সম্পর্ককে আরো অবনতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে হয়ত।
তাহলে আপনি কি করতে পারেন?
তাকে নিয়ন্ত্রণ করবার জন্য আপনাদের মতাদর্শ চাপিয়ে দেবার ব্যাপারটি হিতে বিপরীত হতে পারে। খেয়াল রাখা জরুরি, সে আপনার সন্তান হলেও সম্পূর্ন ভিন্ন একজন মানুষ। সে আর আপনি একই সময়ে বেড়ে উঠেন নি। তার আর আপনার শারীরিক আর মানসিক চাহিদাও একই রকম হবে না বা একইভাবে সেই চাহিদা পূরণ হবে না। আপনি আপনার সন্তানকে আপনার পারিবারিক এবং সামাজিক মূল্যবোধ সম্পর্কে জানাতে পারেন। এসব বিষয়ে তার কি চিন্তাভাবনা সেটাও আন্তরিকভাবে শুনতে পারেন। যার কিছুটা আপনি করেছেনও।
আপনি এবং আপনার স্ত্রী তার সম্পর্কে জড়ানোর জন্য যেসব অসুবিধার আশঙ্কা করছেন এ বিষয়ে খোলামেলা পারিবারিক আলোচনা করতে পারেন। আপনারা যে তাকে ভালোবাসেন, মূল্যায়ন করেন, বিশ্বাস করেন এবং তাকে ব্যক্তি হিসেবে সম্মান করেন তাকে তা অনুধাবন করতে দিন। দোষারোপ না করে সরাসরি আলাপ করুন। তাকে আপনাদের প্রতি আস্তাশীল হবার সুযোগ দিন যাতে করে আপনার সন্তান অনুধাবন করেন যে আপনারাও তার উপর ভরসা করতে পারেন। তার ভালোদিকগুলোকে সরাসরি প্রশংসা করুন। এতে করে আপনার সন্তানের ব্যক্তিসত্তা এবং মুক্তচিন্তা বিকাশের সুযোগ সৃষ্টি হবে যা দীর্ঘমেয়াদে ব্যক্তি হিসেবে আপনার সন্তানকে আরো বেশি দায়িত্ববান এবং সিদ্ধান্তগ্রহণে দক্ষ করে গড়ে তুলবে। পরস্পরের প্রতি আস্থাশীল আলোচনা পারিবারিক সম্পর্কের সংহতি আরো সুদৃঢ় করবে বলে আাশা করা যায়।
এছাড়াও আপনি এবং আপনার পরিবার পেশাদার মনোবিজ্ঞানীর (যেমন, কাউন্সেলিং/ ক্লিনিক্যাল/ এডুকেশনাল) সহযোগিতায় ফ্যামিলি কাউন্সেলিং নিতে পারেন। সর্বোপরি, আপনারা বাবা-মা নিজেদের শরীর ও মনের যত্ন নিতে ভুলবেন না।
আপনার এবং আপনার পরিবারের জন্য শুভকামনা।
মাসুমা আকতার সুমি
এসিস্ট্যান্ট কাউন্সেলিং সাইকোলজিস্ট। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাইকোলজিতে স্নাতক এবং কাউন্সেলিং সাইকোলজিতে স্নাতকোত্তর করে এখন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে স্টুডেন্ট কাউন্সেলর হিসেবে কাজ করছি।