একটি স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে Applied Mathematics বিষয়ে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছি। সমগ্র শিক্ষাজীবনের ফলাফল বেশ ভাল। আমি ছাত্রজীবনের প্রথম থেকেই স্বাবলম্বী। এজন্য আমাকে বিভিন্ন রকমের কাজ করতে হয়েছে। নিজেকে সব রকমের কাজের উপযোগী করে তৈরি করেছি, সাম্ভাব্য সকল প্রকার কাজ শিখেছি। জীবনে বড়কিছু করার স্বপ্ন নিয়ে বড় হয়েছি। পারিবারিক আর্থিক অসচ্ছলতার জন্য অনার্স পরীক্ষার পরেই শিক্ষামন্ত্রণালয়ের একটি প্রজেক্টে যোগদান করি। দুই বছর কাজ করার পর সেটা বন্ধ হয়ে যায় এবং প্রজেক্ট শেষে স্থায়ীকরণের কথা থাকলেও তা আর করেনি, ফলে বেকার হয়ে পরি। প্রজেক্টে চাকরি করার পাশাপাশি অন্য চাকরির চেষ্টা করছি, কিন্তু এ পর্যন্ত ১৩টি সরকারি চাকরির ভাইভা দেবার পরেও একটি চাকরিও জোটাতে পারিনি। চাকরির দিকে হতাশ হয়ে ব্যবসার দিকে মনোযোগ দিলাম। কিন্তু সেখানেও খুব বাজেভাবে ব্যর্থ হয়েছি। এমফিল করার জন্য ভর্তি হলেও আর্থিক সমস্যার কারণে তা শেষ করা হয়নি।
গত কয়েক বছরে যেখানে যে কাজ করতে গিয়েছি সেখানেই খুব খারাপ ভাবে ব্যর্থ হয়েছি। এখন আর কোনো কিছু করার ইচ্ছা বা আত্মবিশ্বাস কোনোটাই নেই। নিজেকে বড় অপরাধী মনে হয়। মনে হয় সবকিছু আমার নিজের দোষেই হয়েছে। ছোটবেলা থেকেই সকল কাজের দায়দায়িত্ব নিজেই নিতে শিখেছি, ফলে আমার ব্যর্থতার দায়িত্ব আমি এড়াতে পারি না। নিজের প্রতি তীব্র ঘৃণা সৃষ্টি হয়েছে। সবসময় নিজের ক্ষতি করার চেষ্টায় থাকি। আত্নহত্যার চিন্তাও করেছি অনেকবার। কিন্তু আমি নিয়ম মানা মুসলিম ফলে সেটা আর করে উঠতে পারি নি। যদিও জানি যে হতাশ হওয়া ইসলামের দৃষ্টিতে অপরাধ, তারপরেও নিজেকে এর থেকে দূরে রাখতে পারি না। নিজের জীবনের কোন মূল্য নেই আমার কাছে। ভয়ঙ্কর সব বিপদজনক কাজে লিপ্ত হই! মনে হয় কেউ আমাকে হত্যা করলে আমি খুব খুশি হতাম। বেঁচে থাকার ইচ্ছা এক বিন্দু পরিমানেও নেই। কাজে কর্মে অসংলগ্ন হয়ে গেছি। আগে লেখালেখি করতাম, এখন কিছুই লিখতে পারিনা। কোন কিছু লিখতে শুরু করলেও মাঝপথে খেই হারিয়ে ফেলি।এইটুকু লিখতে নিজের সাথে অনেক যুদ্ধ করতে হয়েছে। এমনকি পরিষ্কার চিন্তাও করতে পারি না। পৃথিবীতে কাউকে বিশ্বাস করি না। একা থাকতে পছন্দ করি, মানুষ দেখলেই বিরক্ত হই। আমার এই মানসিক অবস্থা পরিবার, বন্ধুরা বা বাহিরের কেউ জানে না। বাহিরের জগতে আমি একজন অত্যন্ত দায়িত্বশীল উচ্ছল প্রাণবন্ত মানুষ। অন্যেরা তাদের সমস্যা নিয়ে আমার কাছে আসে, আমি তাদের সমাধান দেবার চেষ্টা করি। সবাই ভাবে আমার কোন সমস্যা নেই। কিন্তু আমি যে সমস্যায় আছি, যার সমাধান আমার কাছে নেই। অনেক চেষ্টা করেও এর থেকে বের হতে পারছিনা। আমার মনে হয় অনেক আগেই মানসিক ভাবে আমার মৃত্যু হয়ে গেছে, শুধু এই নশ্বর শরীরটা নিয়ে আমি পৃথিবীতে ঘুরে বেড়াচ্ছি ধ্বংসের প্রতিক্ষায়।
আমাদের পরামর্শ
মনোযোগী মন-এ আপনার বর্তমান মানসিক অবস্থা গুছিয়ে তুলে ধরার জন্য অনেক ধন্যবাদ। আপনার এই সংক্ষিপ্ত লেখা থেকে অনুধাবন করছি কতটা কষ্টকর সময়ের মধ্যে দিয়ে আপনি যাচ্ছেন। লেখা থেকে আপনার ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ফুটে উঠেছে। আপনি পড়ালেখায় যথেষ্ট যোগ্যতাসম্পন্ন একজন মানুষ। শুধু তাই নয়, ব্যক্তিগত জীবন পরিচালনার ক্ষেত্রেও আপনি খুব স্বাবলম্বী, দায়িত্বশীল এবং পরোপকারী। এখন এই সংকটময় পরিস্থিতিতেও আপনি আপনার ভালো গুণ এবং দক্ষতাগুলো নিয়ে ভাবতে পারছেন, যা কিনা আপনার বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে একটি বড় শক্তি হিসেবে কাজ করবে আশা করি।
তবে বাস্তবতার টানাপোড়েনে এবং কিছু পরিস্থিতিতে সফলতা না আসায়, আপনি বর্তমানে প্রচন্ড হতাশ ও বিষণ্নবোধ করছেন এবং আত্নহত্যাপ্রবণ হয়ে উঠেছেন। আপনার লেখা থেকে কয়েকটি বিষয়ের উপর আলোকপাত করতে চাইছি।
প্রথমত, আপনার ব্যর্থতার দায়ভার আপনি নিচ্ছেন অর্থাৎ আপনার বর্তমান পরিস্থিতির জন্য আপনি নিজেকেই প্রচন্ডভাবে দায়ি করছেন। যে কোনো পরিস্থিতির জন্য নিজের দায়িত্বের জায়গাটা চিন্তা করা অত্যন্ত জরুরি। সেটা একটা ভালো দিকও বটে। তবে মাত্রাতিরিক্তভাবে এবং দীর্ঘদিন ধরে সেটা চলতে থাকলে তা মনের উপর ভীষণ চাপ সৃষ্টি করে। এই পরিস্থিতিকে ছাদে বসানো পানির ট্যাংকের সাথে তুলনা করা যায়। খেয়াল করে দেখবেন যখন পর্যাপ্ত পরিমানে পানি ট্যাংকে জমা হয় অর্থাৎ এর ধারণ ক্ষমতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ পরিমানে পানি জমা হয়, তখন খুব স্বাভাবিকভাবে বিভিন্ন নলের মাধ্যমে এটা বন্টন হয়। অন্যদিকে যখন অতিরিক্ত সময় ধরে পানি উত্তোলন করা হয় এবং তা যদি এর ধারণ ক্ষমতার বাইরে চলে যায়, তবে ছাদে পানি উপচে পড়ে। অর্থাৎ পানির স্বাভাবিক বণ্টনে ব্যাঘাত ঘটে। এখানে আরও কয়েকটি বিষয় ঘটে, এক পানি সম্পদের অপচয়, দুই দীর্ঘ সময় ছাদের একই জায়গায় পানি পড়ার কারণে অনেক সময় লক্ষ করবেন, ছাদে শ্যাওলাও ধরে যায়। ঠিক একইভাবে প্রত্যেকটি মানুষের যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য মানসিক এবং শারীরিক একটা ধারণ ক্ষমতা থাকে, ঠিক ওই পানির ট্যাংকের মতো। আর দায়িত্বশীলতাটা আপনার একটা দক্ষতা এবং শক্তির জায়গা ঠিক পানি সম্পদের মতো। আর যখন অতিরিক্ত দায়িত্বশীল বোধ করছেন তখনই কিন্তু আপনার দৈনন্দিন জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে, নিজের সম্পর্কে অজস্র এবং মাত্রাতিরিক্ত নেতিবাচক ধারণা এবং অনুভূতির জন্ম নিচ্ছে উপচে পড়া পানির মতো। আর দীর্ঘদিনের সেই নেতিবাচক চিন্তা আর অনুভূতি আপনার ভেতর বিষণ্নতার জন্ম দিচ্ছে, ঠিক ছাদে জমে ওঠা ওই শ্যাওলার মতো! একটু ভেবে দেখবেন, যে কোনো পরিস্থিতি আসলে অনেক কিছুর সমষ্টিগত ফসল। যেমনঃ আপনার চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে অসফলতা শুধু আপনার উপরেই বর্তায়, নাকি আরও অন্য কোনো বিষয় কিছু পেছনে কাজ করেছে, একটু ভেবে দেখবেন। নিজের দায়িত্বের জায়গাটা অস্বীকার করতে বলছি না। তবে নিজের সফলতার মত ব্যর্থতাটাও কিন্তু নিজের এবং সেটাকেও আলিঙ্গন করতে হয়। সফলতার জন্য নিজেকে বাহবা এবং ব্যর্থতার জন্য ক্ষমা করাই কাম্য। ব্যর্থতার কারণগুলো অনুসন্ধান করে, ভবিষ্যতে সে বিষয়ে কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে।
দ্বিতীয়ত, আমরা প্রত্যেকে স্বপ্ন দেখি তবে অনেক সময় তা বাস্তবতার মুখ দেখে না। অথবা অনেক বড় কঠিন লক্ষ্য নির্ধারণ করি যেখানে আবার পৌঁছানো সম্ভব হয় না। তাই যদি লক্ষ্য নির্ধারণটা SMART হয় (যেখানে S = Specific, M = Measurable, A = Achievable, R=Relevent/Reasonable, T=Timely/Time-Sensitive), তাহলে লক্ষ্য অর্জন সহজ হয় বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। আর যখন আমরা একটা সফলতার সাধ পাই, সেটা যত ছোটই হোক না কেন, আমরা কিন্তু তখন ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে থাকি।
আপনি লিখেছেন যে, আপনি ১৩টি সরকারি চাকুরীর সাক্ষাৎকার দিয়েছেন, আসলেই সেটা অনেক ধৈর্যের বিষয়! এক্ষেত্রে কখনও কোনো বেসরকারি চাকুরীর চেষ্টা করা হয়েছে কি? যদিও এটি আপনার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তের জায়গা, তবে অনেক সময় সাধ এবং সাধ্যের সমন্বয় ঘটে না। কিন্তু জীবনকে তো আর থামিয়ে রাখা যায় না, জীবন চলে তার আপন গতিতে। অর্থাৎ একইভাবে বা একই ক্ষেত্রে চেষ্টা না করে যদি ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন কিছু নিয়ে চেষ্টা করা যায় কিনা?
আরেকটি বিষয় উল্লেখ যে, আপনার ভেতরে কি চলছে বা আপনার কোন সমস্যার কথা আপনি বোধহয় কারও সাথে মনখুলে বলতে পারছেন না। সবসময় আপনি অন্যের সমস্যার সমাধান দিয়ে এসেছেন। এক্ষেত্রে বলতে চাই যে, আমাদের প্রত্যেকের জীবনেই এমন কিছু সময় আসে যখন আমাদের কারো না কারো সাহায্যের প্রয়োজন হতে পারে। সেই সাহায্য নেয়াটা দোষের কিছু নয়। নিজেকে ভাল রাখতে এই সাহায্য নেয়া প্রয়োজন। নিজে ঠিক না থাকলে অন্যকে আপনি যথাযথ সাহায্য করতে পারবেন না। এ মুহূর্তে আপনার একজন মানসিক স্বাস্থ্য পেশাজীবী যেমন, এডুকেশনাল, কাউন্সেলিং বা ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট এবং প্রয়োজনবোধে একজন মনোচিকিৎসকের সহায়তা খুবই প্রয়োজন বলে বোধ করছি। অতিসত্বর একজন পেশাদার সাইকোলজিস্টের সাথে সরাসরি দেখা করুণ।
মনের যত্ন নিন, সুস্থ থাকুন। শুভকামনা রইল।
ইরফানা সামিয়া
আমি একজন শিক্ষা মনোবিজ্ঞানী এবং সাইকোথেরাপিস্ট। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মনোবিজ্ঞান-এ স্নাতক, পেশাগত শিক্ষা মনোবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর এবং এম ফিল সম্পন্ন করেছি। তাছাড়া ভারত থেকে কাউন্সেলিং বিষয়ে ডিপ্লোমা করেছি। দীর্ঘ ১৩ বছর কাউন্সেলিং পেশার সাথে যুক্ত আছি। বর্তমানে একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে সিনিয়র কাউন্সেলর হিসাবে কাজ করছি।