হাসিমুখের বিষণ্ণতা

হাসিমুখের বিষণ্ণতা- আলোর নিচের অন্ধকার

সদা হাস্যজ্জল মানুষকে কার না ভাল লাগে। হাসিমুখে থাকতে পারাও তো একটি গুণ। আমাদের চারপাশে এমন অনেকেই থাকেন, ভেতরে ভেতরে যাই চলুক না কেন, মুখে লেপটে থাকে হাসি। হয়ে উঠেন সবার প্রিয়মুখ। হাসি ঠাট্টা, উচ্ছলতা ও কাজ নিয়েই ব্যস্ত সময় পার করেন। এরকম একজন মানুষও কী মানসিক অসুবিধায় ভুগতে পারেন? তারও কী হতে পারে বিষণ্ণতা? অবাক শোনালেও, কথা কিন্তু সত্য। সদা হাস্যজ্জল মুখের আড়ালে থাকতে পারে ভয়ানক মন খারাপের কিছু। ধুঁকে ধুঁকে জ্বলতে পারে হতাশার শিখা। চিকিৎসা বিজ্ঞান যার নাম দিয়েছে ‘হাসিমুখের বিষণ্ণতা (Smiling Depression)’। আজকে এটা নিয়েই আলাপ করব।   

সাধারণভাবে বিষণ্ণতার কথা বললে আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠে দুঃখবোধ,  কিছু ভালো না লাগা, অল্পতেই কাঁদা, কর্মক্ষমতা হ্রাস পাওয়া, অবসাদ, অরুচি, ঘুমের গোলযোগ ইত্যাদি নানা উপসর্গ। অর্থাৎ বিষণ্ণতায় আক্রান্ত ব্যক্তি মানেই যেন দুঃখের কালো মেঘ মাথার উপর নিয়ে চলতে থাকা কেউ। এই সরলীকৃত চিন্তা অনেক সময় গুরুতর অসুবিধাগুলোকে চোখের আড়াল করে ফেলে। কেননা, ব্যক্তিবিশেষে বিষণ্ণতার অভিজ্ঞতা ভিন্ন হতে পারে। যেমন, স্মাইলিং ডিপ্রেশনে আক্রান্ত ব্যক্তি ভেতরে লুকিয়ে রাখেন অনেক গুরুতর অসুবিধা। বাইরে থেকে যা বোঝা মুশকিল। বাইরে থেকে দেখলে অনেক সময়ই তারা ভালো আছেন বলে ভ্রম হয়। এমনকি Smiling Depression এ ভুগতে থাকা অনেকেই আশ্চর্য হন যখন বলা হয় যে তারা ডিপ্রেশনে ভুগছেন। আর এরকম কষ্ট চেপে রাখা মানুষের সংখ্যা কিন্তু কম নয়।

বিষণ্ণতায় আক্রান্ত অনেকেই বিষণ্ণ হওয়া সত্ত্বেও দৈনন্দিন সাধারণ কাজগুলো ভালোভাবেই করেন। তারা গম্ভীর নন বরং অন্যদের সাথে হাসি আনন্দেও অংশ নিয়ে থাকেন। এ ধরনের ব্যক্তিরা হাসিমুখের আড়ালে নিজেদের দুঃখ কষ্ট লুকিয়ে রাখেন। দিনের পর দিন বহন করতে থাকা সেই মুখোশের ভার সহ্য করার ক্ষমতা একসময় নিঃশেষ হয়ে যায়। তখন দেখা দেয় মারাত্মক অসুবিধা। নিজেদের কষ্ট-দুঃখ, দুঃশ্চিন্তা লুকিয়ে রাখাটা মানুষের একটা সাধারণ প্রবণতা। কিন্তু এই ভালো থাকার মুখোশ পরে থেকে আমরা মূলত সাহায্য পাবার পথটি বন্ধ করে ফেলি। ফলে ধীরে ধীরে বিষণ্ণতার দিকে এগিয়ে যেতে থাকি। জরিপে দেখা যায়, ৭১% ডিপ্রেশনে আক্রান্ত ব্যক্তি তাদের ডিপ্রেশনকে আড়াল করার চেষ্টা করে থাকেন।

উপসর্গ

Smiling Depression এ আক্রান্ত ব্যক্তির ঘুমের সমস্যা, কিছু ভালো না লাগা, খুব রাগ অনুভব করা, সবকিছুতে বিরক্তিভাব, দুশ্চিন্তা, নিজেকে তুচ্ছ মনে হতে থাকার মত আবেগ কাজ করতে পারে। অনেকক্ষেত্রে সার্বক্ষণিক মন খারাপ বা দুঃখের একটি অনুভূতি তাকে ঘিরে থাকে। “জীবনে কিছুই ঠিক হচ্ছে না” এমন চিন্তা আসতে থাকে যদিও তার পেছনে সঠিক কোনো কারণ সে খুঁজে পায় না। স্বাভাবিক যৌনসম্পর্ক রক্ষা করতেও তারা আগ্রহ হারিয়ে ফেলে।

থেরাপিস্ট Tanya Komblevitz‘র মতে নিচের নয়টি লক্ষণের মধ্যে অন্তত পাঁচটি লক্ষণ যদি আপনার মধ্যে থাকে তাহলে বলা যায় আপনি বিষণ্ণতায় ভুগছেন।

  • কোনো বিষয়ে মনোযোগ দিতে বা ধরে রাখতে অসুবিধা হওয়া।
  • উদ্দেশ্যহীনভাবে ক্রমাগত কিছু করতে থাকা।
  • প্রায় সব সময়ই মন খারাপ থাকা ও হতাশা কাজ করা।
  • অধিকাংশ সময় ক্লান্ত বোধ করা।
  • প্রায়ই কোনো অস্পষ্ট বিষয় নিয়ে গ্লানি বা অপরাধবোধ কাজ করা।
  • এক সময় যেসব কাজ আগ্রহের সাথে করতেন এখন সেগুলোর প্রতি কোনো আগ্রহ বোধ করেন না বা সেসব কাজ করে আনন্দ পান না।
  • লক্ষণীয় মাত্রায় ওজন হ্রাস বা বৃদ্ধি হওয়া এবং খাওয়ার রুচি হঠাৎ করে খুব বেড়ে যাওয়া বা কমে যাওয়া।
  • হঠাৎ ঘুম খুব বেড়ে যাওয়া বা ঘুমাতে না পারা।
  • বারবার আত্মহত্যার চিন্তা আসা।

কেন মানুষ বিষণ্ণতাকে আড়াল করার চেষ্টা করে?

  • নিজের বিষণ্ণতা বা মানসিক অসুবিধা নিয়ে লজ্জিত হওয়ায় অনেকে বিষণ্ণতাকে আড়াল করতে চেষ্টা করেন। কারণ মানসিক অসুস্থতা নিয়ে আমাদের সমাজে নেতিবাচক মনোভাব রয়েছে।  
  • কখনো কখনো ব্যক্তি নিজের বিষণ্ণতাকে চিনতে পারেনা। চিনতে পারলেও মনে করে এটা এক সময় নিজে নিজেই ভালো হয়ে যাবে। আবার, অনেক সময় নিজের খারাপ লাগাকে অবদমিত রেখে জোর করে হাসি ধরে রাখা বা স্বাভাবিক কাজকর্ম চালিয়ে যাবার চেষ্টা করে।
  • অনেক ব্যক্তি নিজের সমস্যা নিয়ে অন্য কাউকে বিরক্ত করতে চায়না। ফলে নিজের কষ্ট আর অসুবিধা নিজের কাছেই রেখে ভুগতে থাকে। তারা চায়না অন্য কেউ তাদের নিয়ে দুশ্চিন্তা করুক বা তারা কারো বোঝায় পরিণত হোক।
  • অনেকেই নিজের ইমেজ নিয়ে অত্যন্ত চিন্তিত থাকেন। নিজেকে সব সময় ‘পারফেক্ট’ হিসাবে উপস্থাপন করাকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেন। ফলে নিজের শারীরিক বা মানসিক সীমাবদ্ধতা গোপন রাখার একটা চাপ অনুভব করেন।  

কাদের মধ্যে দেখা যায়?

  • আত্মকেন্দ্রিক ব্যক্তিদের মধ্যে স্মাইলিং ডিপ্রেশন বেশি দেখা যায় কেননা তারা সাধারণত নিজের ব্যাপারে অন্যকারো সাথে কথা বলতে পারেন না।
  • খুতখুতে বা পারফেকশনিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে।
  • যাদের কাঁধে অনেক বেশি দায়িত্ব থাকে। তারা মনে করেন তিনি ভেঙে পড়লে অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যাবে তাই তাকে কিছুতেই ভেঙে পড়া চলবেনা।

স্মাইলিং ডিপ্রেশন কেন বিপদজনক?

যে বিষাদগ্রস্ত ব্যক্তিটি নিজেকে আড়াল করে হাসিমুখে থাকার সিদ্ধান্ত নেন তার হাসিমুখ কিন্তু তাকে তার পীড়াদায়ক অনুভূতি থেকে মুক্তি দেয়না। নিজের আবেগ অনুভূতিকে কখনোই অবহেলা বা আড়াল করা উচিৎ নয় কেননা এর মাধ্যমে আবেগ অনুভূতিগুলোর অস্তিত্ব বিলোপ করা যায়না। ফলে দেখা যায়, ব্যক্তি হয়ত আড়াল করার মাধ্যমে ডিপ্রেশন থেকে মুক্তি পাবে বলে আশা করে, কিন্তু এর মাধ্যমে সে বরং তার হতাশাকেই আরো বড় করে তোলে। এক সময় হাসিখুশি থাকার মাধ্যমে জোর করে চেপে রাখতে চাওয়া ব্যাপারগুলোই বড় আকার ধারণ করে। যার কারণে স্মাইলিং ডিপ্রেশনে আক্রান্ত ব্যক্তিদের অধিকাংশ আত্মহত্যার ঘটনাই সবার কাছে অবিশ্বাস্য বলে মনে হয়।

যারা ডিপ্রেশন আড়াল করার চেষ্টা করতে থাকেন তারা শেষতক এমন একটি জীবনযাত্রা ধারণ করেন যা আসলে তার নয়। এর ফলে ব্যক্তির অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব গুরুতর আকার ধারণ করে কেননা সবার সামনে সর্বদা হাসিখুশি খুবই কঠিন ব্যাপার। আগে হোক পরে হোক এক সময় সমস্ত রাগ, ক্ষোভ, কষ্ট, দুশ্চিন্তা নিজেদের বেরিয়ে আসার একটি পথ করেই নেয়। তাই সেসব বিশাল কষ্ট দুঃখের সামনে হঠাৎই পড়ার পর ব্যক্তি খুবই অসহায় বোধ করতে থাকে। এ কারণে স্মাইলিং ডিপ্রেশনে আক্রান্ত ব্যক্তি অধিক ঝুঁকির মধ্যে থাকে।

কী করা যাতে পারে?

খারাপ অনুভূতি নিজে থেকে দূর হয়না। নেতিবাচক আবেগ অনুভূতির মুখোমুখি হয়েই তাদের মোকাবিলা করতে হবে। এক্ষেত্রে অবশ্যই পেশাদার মানসিক স্বাস্থ্যসেবীর (মনোচিকিৎসক, ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট বা কাউন্সেলিং সাইকোলজিস্ট) সহায়তা নিতে হবে। সেই সাথে ব্যক্তির সদিচ্ছা আর পরিবার, প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবের সহয়তায় বিষণ্ণতায় আক্রান্ত ব্যক্তি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠতে পারেন।

আমাদের আশেপাশে কেউ তার বিষণ্ণতাকে আড়াল করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বলে মনে হলে, তার সাথে খোলামেলা কথা বলার চেষ্টা করা প্রয়োজন। তবে তাদের অবস্থা জানার জন্য চাপ প্রয়োগ করা উচিৎ নয় কেননা এতে তারা নিজেকে আরো গুটিয়ে নেয়। এর পরিবর্তে আমরা আমাদের আন্তরিকতা ও সদিচ্ছা তাকে দেখাতে পারি এবং নিজের কথা শেয়ার করার মাধ্যমে তার সাথে আত্মিক বন্ধন তৈরির মাধ্যমে তাকে আপন করে নিতে পারি।

সুমাইয়া তাসনিম
+ posts

শিক্ষার্থী, মনোবিজ্ঞান বিভাগ

ইডেন মহিলা কলেজ, ঢাকা।

Post Author: সুমাইয়া তাসনিম

শিক্ষার্থী, মনোবিজ্ঞান বিভাগ ইডেন মহিলা কলেজ, ঢাকা।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।