বাথরুমে কল ছেড়ে দিয়ে ভিজতে ভিজতে দীপান্বিতা (ছদ্মনাম) অঝোরে কাঁদছে। পানিতে পুরো শরীর ভিজে যাচ্ছে। তবুও মনে হচ্ছে শরীর থেকে নোংরা যাচ্ছে না। বার বার পাগলের মতো হাত পা ঘষছে। আর মনে মনে একটা প্রশ্নই নিজেকে করে চলেছে, ‘কেন এমন হল?’ ‘আমার সাথেই কেন এমন হবে?’
সকালে ঘুম থেকে উঠে কত আনন্দই না ছিল তার মনে। এইতো কিছুদিন আগেই সে ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে। প্রতিদিন সময়মত ভার্সিটিতে যায়। নতুন বন্ধু হয়েছে তার। তাদের সাথে নিয়মিত ক্লাস করা, আড্ডা দেয়া, ক্যাফেটেরিয়ায় বসে চা খেতে খেতে পড়াশুনা নিয়ে আলোচনা করা, সবকিছুই সে খুব উপভোগ করে। বন্ধুদের মধ্যে নাদিয়া, ডালিয়া, সময়, সৌরভ ও পূজা তার খুব কাছের। তবে, পড়াশুনার কথা বললে ‘সময়’ ছেলেটিকেই এগিয়ে রাখতে হবে। কী দারুণ মেধাবী! সে-ই তাকে বেশি সহযোগিতা করে। সব ভালোর মধ্যে যেমন কিছু খারাপ লুকিয়ে থাকে, সময়-য়ের মধ্যে তেমন কিছু একটা লক্ষ্য করেছে দীপান্বিতা। ছেলেটি কারণে অকারণে নোংরা নোংরা জোকস বলে। খুবই বিরক্তিকর! এই যেমন সেদিন সে মৌটুসির শরীর নিয়ে খুব বাজে একটা কথা বলল। দীপান্বিতা সেই কথার প্রতিবাদ করে বলেছিল, “মানুষের শরীর নিয়ে বাজে কথা বলবি না সময়। খুবই ছোটলোকি অভ্যাস”। সেদিন সময় চুপসে গিয়েছিল।
অথচ সেই সময় আজ এমন একটা কাজ করে বসবে সে ভাবতেও পারেনি। আজ ক্লাস শেষ করে সে সবেমাত্র বের হয়েছে। নাদিয়া, সময় ও সৌরভ তখন কি যেন একটা বিষয় নিয়ে কথা বলছিল। সকালে তাড়াহুড়ো করে ক্লাসে আসায় নাস্তা করা হয়নি দীপান্বিতার। তাই সে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলে, ‘চল, নাস্তা করি’। তখন, সময় হঠাৎ তার হাতটা চেপে ধরে বলে, ‘চল, আজ আমিই তোকে নাস্তা করাবো’। দীপান্বিতা তখনও বুঝতে পারেনি, সময়ের মনে আসলে কি চলছিল। সে হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, ‘ঠিক আছে, চল’। এরপর তারা দু’জন ক্যাফেটেরিয়ায় যাবার উদ্দেশ্যে ছয়তলার লিফটে গিয়ে উঠলো। লিফটে আর কেউ ছিলনা। লিফটের দরজা বন্ধ হতেই, আকস্মিক সময় তাকে জড়িয়ে ধরলো। জোর করে চুমু খাওয়ার চেষ্টা করল। অন্যদিকে আরেক হাত দিয়ে দীপান্বিতার বুকেও হাত চালাতে লাগলো। ঘটনার আকস্মিকতায় দীপান্বিতা এতই হতবাক হয়ে গেল যে, সে কোনো প্রতিবাদই করতে পারল না। ভাগ্যিস, তিরিশ সেকেন্ডের মধ্যে লিফটের দরজাটা খুলে গেল। আর অমনি ঝট করে সময় দীপান্বিতাকে ছেড়ে দিয়ে দ্রুতগতিতে পালালো। এদিকে দীপান্বিতা বুঝতেই পারছিল না তার এখন কি করা উচিৎ। রাগ, ঘেন্না, অপমান নাকি অসহায়ত্ব, কী বোধ করছে সে? কিছুই ধরতে পারল না। শুধু চোখ দিয়ে কয়েক ফোটা জল গড়িয়ে পড়ল। এরপর সে অনেক কষ্টে বাড়িতে পৌছেই বাথরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে আছে।
আমাদের দেশে এমন অসংখ্য দীপান্বিতা আছে, যারা এইরকম শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়। হ্যাঁ, খুব পরিচিতজনদের দ্বারাও হয়। সেটাই বড় আশংকার। কাকে কতটুকু বিশ্বাস করবেন? নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে পাবলিক প্লেস থেকে শুরু করে বদ্ধ জায়গায়। মেয়েদের বাসে-ট্রেনে বা রাস্তাঘাটে একা একা চলাফেরা তো রীতিমতো অসম্ভব হয়ে পড়েছে। আমি খুব কম মেয়ের কথায় শুনেছি যারা কখনোই বাসে-ট্রেনে হয়রানির শিকার হয়নি। স্টেশনে যখন কোন ট্রেন এসে দাড়ায়, খুব স্বাভাবিকভাবেই সবাই ট্রেনে ওঠার জন্য দরজায় গিয়ে ভীর করে। সেখানেও ভীড়ের সুযোগ নিয়ে, কিছু বিকৃত রুচির ছেলে বা বয়স্ক মেয়েদের শরীরে হাত দেয়। মেয়েটা হতদম্ভ হয়ে কিছু বুঝে ওঠার আগেই, লোকটা তার শখ নিবৃত করে পালিয়ে যায়।
কেনো একজন ছেলে এরকম বিকৃত রুচির অধিকারী হচ্ছে? সমস্যাটা আসলে কোথায়? আইনের শাসনের অভাব, অর্থনৈতিক বৈষম্য, পুরুষতান্ত্রিক সমাজ কাঠামো, শিক্ষা, সামাজিকীকরণ, ইত্যাদি নানা কথা যুগযুগ ধরে আলোচনা হয়ে আসছে। সভা সেমিনার হচ্ছে। ফল কী তেমন পাচ্ছি? আর ব্যক্তি হিসেবে আমাদেরই কী করার কিছু আছে?
সেসব প্রশ্নের উত্তর দেয়ার আগে আরেকটি গল্প বলি। সুমি, ভার্সিটির ৪র্থ বর্ষের ছাত্রী। সে তার ফুফুর সাথে বসে একদিন টেলিভিশনে সিরিয়াল দেখছে। এসময় তার তিন বছরের ফুপাতো ভাই খেলতে খেলতে টিভির রুমে আসে। হঠাৎ সে সিরিয়ালের নায়িকার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘ওর দুইটা হেডলাইট আছে’। কথাটা শুনে সুমি খুব অবাক। সে তার ফুফাতো ভাইকে সাথে সাথেই জিজ্ঞেস করে, ‘তুমি একথা কোথায় শুনেছো’? বাচ্চাটির তাৎক্ষনিক উত্তর, ‘আব্বুর কাছে’।
ছোট্ট এই শিশুটি সমাজ, রাষ্ট্র, আইন কানুনের ধারনা এমনকি তার নিজের জেন্ডার আইডেন্টিটি পর্যন্ত গড়ে উঠেনি। অথচ, পরিবারে সে শিখে গেছে, তার থেকে দেখতে ভিন্ন, যাদেরকে মেয়ে বলে, তাদের বুকে ‘হেডলাইট’ আছে। এটা কী সে কোনোদিন ভুলবে? তার মনস্তত্ত্বে কী নারীদের জন্য সম্মান জন্মাবে?
প্রানী মানুষ আসল ‘মানুষ’-এ পরিণত হয় পরিবার, সমাজ তথা তার সংস্কৃতির মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে। আর সে কতটা পরিণত হয়েছে তা ধরা হয়, সে কত ভালোভাবে নিজের ‘ইম্পালস কনট্রোল’ করে সামজের সাথে খাপ খায় এমন আচরণ রপ্ত করতে শিখেছে। তার মধ্যে রাগের অনুভুতি হলে, সে ধপ করে সহপাঠির গালে চড় মারে না। সবার সামনে নাকে আঙ্গুল দিয়ে ময়লা পরিষ্কার করে না। খিদা লাগলেও অন্যের খাবার নিয়ে খেতে বসে না। এগুলো যখন সে করেনা, তাহলে একটি মেয়েকে দেখলে বা মেয়েটিকে একলা পেলে, কেন সে অপ্রত্যাশিত আচরণ করবে? এটাও তো সমাজের কোনো গ্রহণযোগ্য রীতি না। নিশ্চয় তার বেড়ে উঠার ইতিহাসে কিছু গলদ আছে।
সাধারণত নারী উত্যক্তকারী ছেলেরা বা নির্যাতনকারী পুরুষেরা নিজেরাও ভীষণ মানসিক পীড়ন আর অস্থিরতার মধ্যে বেড়ে উঠে। তারপর যখন নিজে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটায়, সেই পীড়াদায়ক যন্ত্রণা আরো বেড়ে যায়। সাময়িকভাবে সে তৃপ্ত বা জয়ী বোধ করলেও পরবর্তীতে অনুশোচনাবোধে ভোগে। যদি সে মারাত্মক কোনো সাইকোপ্যাথ না হয়ে থাকে।
পরিশেষে বলতে চাই, ছেলেমেয়ে উভয়ের একটি স্বস্তিদায়ক আগামীর জন্য আসুন আমাদের আজকের ছোট ছোট আচরণগুলো খেয়াল করি। চেতনে অবচেতনে শিশুদের মনে কী দিচ্ছি, তাও লক্ষ্য রাখি। সবার জন্য ভালোবাসা।
মল্লিকা দে
প্রভাষক
মনোবিজ্ঞান বিভাগ
আই,ইউ,বি,এ,টি বিশ্ববিদ্যালয়
উত্তরা, ঢাকা।