কখন যে শেষ হবে

কখন যে শেষ হবে…!

অফিস আসা যাওয়ার রাস্তার কথা মনে পড়লে আমার খুব খারাপ বোধ হতো। রাগ, ক্ষোভ, আর বিরক্তিতে পুরোটা পথ বিড়বিড় করতাম। কারণটা আর কিছুই না, উন্নয়ন কাজের জন্য রাস্তার বেহাল দশা! ঢাকার রামপুরা, মৌচাক, মালিবাগের কথা বলছি। এই পথদিয়েই প্রতিদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে হয়।  

প্রথমে শুরু হলো পানির লাইনের কাজ। চলল খুড়াখুড়ি, কাটাকাটি।

এটা শেষ হতে না হতেই শুরু হলো গ্যাস ও বিদ্যুত লাইনের কাজ। কিছুদিন আগের ঠিক করা রাস্তা আবার খুড়াখুড়ি, কাটাকাটি।

জনগণের উন্নয়নের জন্য করা হচ্ছে! নিজে একজন জনগণ হিসেবে বলা যায় এটা আমার সমস্যা, তার জন্যে লোক লাগিয়ে কাজ করাচ্ছি।

ঠিকাছে, বুঝলাম। কিন্তু কতদিন?

তিনমাস পর শেষ হলো। ভাবলাম, শেষ বুঝি।

কিন্তু না, এবার শুরু শৌচাগার সঞ্চালন লাইনের সংস্কার কাজ।

কাজ চলছে, কষ্ট ভোগ করছি আর অপেক্ষা করছি… কাজ শেষ হলো।

এরপর মনে হলো সব শেষ, শান্তি…

কিন্তু না, কিছুদিনের মধ্যেই আবার ফ্লাইওভারের কাজ শুরু…

সেই যে শুরু হলো, শেষ হবার কোন খবর নেই… এখনও চলছে।  

এসব উন্নয়ন আর সংস্কার কাজের ফলে চলাচলের রাস্তা ছোট হয়ে গেছে, খানা খন্দকে ভরে গেছে। চলাচলের একপ্রকার অনুপুযুক্ত হয়ে পরেছে। আরো আছে, রাস্তার মধ্যে ইট, বালু, রড যেখানে যেখানে পরে থাকছে। সংস্কার কাজের প্রয়োজনীয় মেশিন, সরঞ্জামাদি রাস্তার মধ্যে ঝুকিপূর্ণ অবস্থায় থাকে।

এসব সংস্কার আর উন্নয়নের কাজ সমাপ্ত হলেই আমাদের শুধুই শান্তি আর শান্তি। সেই শান্তির কথা কল্পনা করে না হয় কিছুদিন কষ্ট করি!

কিন্ত আসলে কী আমাদের কষ্ট শেষ হয়ে যাবে?

হঠাৎ খেয়াল করলাম, আরে এগুলো তো উন্নয়নমুলক কাজ। উন্নয়ন তো একেবারেই শেষ হয়ে যায় না। সময়ের সাথে নতুন সমস্যা বা চাহিদার উদ্ভব হতে পারে। তখন আবারো খুঁড়াখুঁড়ি শুরু হবে…

উন্নয়ন একটি চলমান প্রক্রিয়া।

হায়রে কপাল, তার মানে কষ্ট কী আর পিছু ছাড়বে না?

আমার মতো আপনিও কী ভাবছেন, কষ্ট আর সমস্যা থেকে আমাদের মুক্তি নেই!

অবশ্যই আছে।

ভেবে দেখুন, এরকম কাজ কী শুধু আমাদের দেশেই হচ্ছে। নিশ্চয় না। এর থেকে অনেক মেগা মেগা উন্নয়ন প্রজেক্ট হচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। মাটির ভেতর স্তরে স্তরে রেলপথ, এমনকি সমুদ্রের ভেতর দিয়ে, পাহাড় সুরঙ্গ করে রাস্তা, রেলপথ তৈরি করেছে এবং করছে। তারা কীভাবে করছে?

বিভিন্ন দেশে নিজের দেখা অভিজ্ঞতা আর বিভিন্ন তথ্য ঘেটেঘুটে বুঝলাম, উন্নয়ন প্রজেক্ট সমস্যা না, সমস্যা হলো, কীভাবে, কত দক্ষভাবে আমরা কাজটা করতে পারছি, সেটা। অর্থাৎ উন্নয়ন কাজগুলো মানুষের সবচেয়ে কম অসুবিধা করে কতটা দক্ষতার সাথে করছি, সেটাই আসল ব্যপার। সেটাই আসলে বলে দেয় কে কতটা স্মার্ট। কে কতটা সক্ষমতা অর্জন করেছে।

এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ মনে হলো, জীবন নিয়েও কী আমি একই চিন্তাই আছি? কোনো একটা সমস্যা দেখা দিলে অস্থির হয়ে ভাবি, কখন যে এটা শেষ হবে!

কখন যে পড়াটা শেষ হবে?

কখনযে চাকরিটা হবে?

কখন যে বিয়ে করতে পারব?

কখন যে অসুখটা সেড়ে যাবে?

কখন যে সন্তান বড় হবে, বুঝতে শিখবে?

কখন যে…

কখন যে…

এই ‘কখন যে টা’ এসে গেলেই সব কিছু থেকে মুক্তি। আহ!, আরাম করে চাকরি, শান্তির সংসার…বাচ্চা কাচ্চা…

কিন্তু না, পড়া শেষ হলেও চাকরি হচ্ছে না…

চাকরি হলেও মনের মতো পোস্টিং হচ্ছে না…

পোস্টিং হলেও বিয়ে হচ্ছে না…

বিয়ে হলেও শান্তি থাকছেনা…স্বশুরবাড়ি…বাপের বাড়ি…আত্মীয়স্বজন…মনোমালিন্য…এরপর সময়মত বাচ্চাকাচ্চা…

এরপর……

থাক, কী দরকার আর এসব বলে। আপনি আমার চেয়ে ভালো বোঝেন।

ব্যপারটা কী দাড়ালো?

উন্নয়ন কাজ যেমন চলমান, আমাদের জীবনটাও চলমান। তাতে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন সমস্যার আবির্ভাব হবে।

ভালো থাকার, সুখে থাকার ফরমুলা তাই সমস্যা না থাকা বা শেষ হয়ে যাওয়া নয়, বরং সমস্যা মোকাবেলা করার সক্ষমতা বাড়ানো। এটাই মুল কথা।

আজকে যে মায়ের খিটখিটে স্বভাবের জন্য আপনার জীবন বিষাদময় হয়ে ওঠেছে বলে মনে করছেন, এই মানুষটা থেকে মুক্তি চাচ্ছেন, কালকে যে এরকম আরো একজন মানুষ আপনার জীবনে আসবেনা, তার নিশ্চয়তা কী কেউ দিতে পারে?

সুতরাং জীবনে সমস্যা থাকাটাই সমস্যা না, বরং সমস্যা মোকাবেলা করার সক্ষমতার ঘাটতিই বড় সমস্যা।

এবার আপনি ভেবে বের করুন, আপনার জীবনের যে সমস্যাগুলো থেকে আপনি পরিত্রাণ চাচ্ছেন, সেগুলো মোকাবেলা করার পর্যাপ্ত সক্ষমতা কি আপনার আছে? যদি না থাকে, তবে এখনি মনোযোগী হন, কীভাবে সেই সমস্যা মোকাবেলা করার সক্ষমতা বাড়াবেন

আমি জানি আপনিই পারবেন। কোন সন্দেহ নেই! শুধু মনে রাখুন,

ভালো থাকা কোনো ভবিষ্যতের বিষয় না; 

ভালো থাকা কোনো শর্তের ওপর নির্ভর করেনা।  

 

আজহারুল ইসলাম
আজহারুল ইসলাম
+ posts

কাউন্সেলিং সাইকোলজিস্ট।
সহযোগী অধ্যাপক, এডুকেশনাল এন্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

প্রকাশিত বই

হইচই (২০১৯) 
মনোসন্ধি (২০১৭)
জাদুকাঠি (২০১৬) 

Post Author: আজহারুল ইসলাম

কাউন্সেলিং সাইকোলজিস্ট। সহযোগী অধ্যাপক, এডুকেশনাল এন্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। প্রকাশিত বই হইচই (২০১৯)  মনোসন্ধি (২০১৭) জাদুকাঠি (২০১৬) 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।