আমি তখন সপ্তম শ্রেণিতে পড়ি।
আমাদের বিদ্যালয়টি থানার একদম পাশেই অবস্থিত হওয়ায় বিভিন্ন সময় নানারকম অপরাধ আর অপরাধীদের খবর পেতাম খুব সহজেই। পাশাপাশি কোনো হত্যা বা আত্মহত্যা ঘটলে লাশটিও এনে রাখা হতো থানার লিচু গাছ তলায়। আমাদের কমনরুম আর মেয়েদের সপ্তম শ্রেণির ক্লাস রুমটি ছিল একদম লিচু গাছের পাশেই। সেই সুবাদে প্রায়ই বাঁশের চাটাই বা ধারি দিয়ে মোড়ানো, পা বের হওয়া লাশ দেখা হয়েছে আমার।
তবে বেশি আগ্রহ কাজ করত আত্মহননকারী লাশ গুলো নিয়ে। ওই বয়সে বুঝতাম না, কেন ওরা নিজেকে নিঃশেষ করে ফেলে! কী এমন ঘটেছিল তাদের জীবনে যে বাবা-মাকে ছেড়ে সুন্দর পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়? ওদের কী কোনো ইচ্ছা বা স্বপ্ন থাকে না? নানা প্রশ্ন উঁকি দিত মনে। কোনো জবাব পেতাম না!
কিন্তু এখন বেশ কিছু বুঝতে পারি; আত্মহত্যার আড়ালে লুকানো আসল সত্য কারণগুলো কী কী, কেনই বা তারা এ পথ বেছে নেয়।
চতুর্থ শতক পর্যন্তও পাশ্চাত্য ভাবনায় আত্মহত্যাকে নিন্দার চোখে নয় বরং এক ধরনের অপরাধ হিসেবে গণনা করা হতো। আর তের শতকের দিকে সেটাকে মনে করা হতো নৈতিক পাপ হিসেবে। অদ্ভুত বিষয় হচ্ছে বর্তমানেও আমেরিকার কিছু কিছু প্রদেশে আত্মহত্যাকে সামান্য অপরাধ হিসেবে দেখা হয়!
সাধারণভাবে আত্মহত্যা হচ্ছে অনিবার্য মৃত্যু। আত্মহত্যা বলতে নিজের জীবনকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নিজের দ্বারা নিঃশেষ করাকে বোঝায়। আত্মহত্যার পিছনে কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে- অবাস্তব এবং উচ্চ প্রত্যাশার বাস্তবায়ন না হওয়া, মানসিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি লাভ, অতিরিক্ত বিষণ্ণতা, পারিবারিক কলহ, যৌন নির্যাতন, মাত্রাতিরিক্ত ও অনিয়ন্ত্রিত আবেগ ইত্যাদি। গবেষকদের মতে, মানুষের মস্তিষ্ক যখন তার এজাতীয় জটিল সমস্যায় কোনো সমাধান খুঁজে পায় না, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তখনই আত্মহননের পথ বেছে নেয়। বাংলাদেশের গবেষণায় পাওয়া গিয়েছে এদেশে আত্মহত্যাকারীদের ৪৬ দশমিক দুই শতাংশই বিষণ্নতায় ভুগতো।
এমিল ডুর্কহাইম এর মতে আত্মহত্যা একটি সামাজিক ঘটনা এবং সামাজিক বিশৃঙ্খলা-ই হলো আত্মহত্যার উৎস। তিনি ৩ ধরনের আত্মহত্যাকে চিহ্নিত করেন।
Egoistic আত্মহত্যা
ব্যক্তি ও সমাজের মাঝে দূরত্ব বৃদ্ধি পেলে এ ধরনের আত্মহত্যা সংঘটিত হয়। এই আত্মহত্যা পরিবার ও তার মধ্যকার দুর্বল বন্ধনকে প্রকাশ করে।
Altruistic আত্মহত্যা
ব্যক্তি যখন গোষ্ঠী বা জাতির স্বার্থে নিজ ইচ্ছায় আত্মহননের পথ বেছে নেয়।
Anomic আত্মহত্যা
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ব্যক্তি যখন সমাজের সাথে নিজেকে খাপ খাওয়াতে ব্যর্থ হয় তখন সমাজে এ ধরনের আত্মহত্যা দেখা যায়।
মানসিক রোগীদের ক্ষেত্রে Bi-polar, Depression এবং Borderline Personality Disorder –এ আক্রান্তদের মাঝে বেশি আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা যায়। এছাড়াও Schizophrenia-আক্রান্তদের কিছু অংশও আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।
উন্নত বিশ্বে সাধারণত বিষণ্ন মদ্যপ পুরুষগণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আত্মহত্যা করে থাকেন। অপরদিকে আমাদের দেশে এ হার নারীদের বেলায় বেশি।
বিভিন্ন পেশার মধ্যে সাইকিয়েট্রিস্ট, সাধারণ চিকিৎসক, আইনজীবি এবং ডেন্টিস্টরা বেশি আত্মহত্যার ঝুঁকিতে থাকেন!
কামরুন নাহার খান পিন্নী
ট্রেইনি এডুকেশনাল সাইকোলজিস্ট, এডুকেশনাল এন্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ভাল লাগে নতুন কিছু ভাবতে ও নতুনের সাথে পরিচয় হতে। আর ইচ্ছে করে প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে যেতে।