মনের জোরে মড়ক বধঃ Covid19 ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা

মনের জোরে মড়ক বধঃ Covid19 ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা

কখনো কি ভেবে দেখেছেন, কেন কেউ খুব সহজে রোগে আক্রান্ত হয়, কেউ আবার রোগ থেকে দ্রুত সেরে হয়ে ওঠে, আর কেউ বা মরেই যান? অসুখবিসুখে আক্রান্ত হওয়া এবং তা থেকে সেরে উঠা বহুলাংশে নির্ভর করে আমাদের শারীরিক ও মানসিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার উপর। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হচ্ছে অসুখবিসুখের বিরুদ্ধে শরীরের লড়াই করার নিজস্ব ক্ষমতা। এই ক্ষমতা ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হয়। যদি আপনার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকে তাহলে কোন অ্যানটিবায়োটিক বা ভ্যাকসিন ঠিক মতন কাজ করবে না।

রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ও মানসিক স্বাস্থ্য

আপনি কি জানেন আপনার আবেগ যেমন রাগ কষ্ট, বিরক্তি, হতাশা, বিষণ্নতা, আনন্দ কিংবা ভালোবাসা আপনার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে প্রভাবিত করে? নিউরো-মনোবিজ্ঞানীরা দেখেছেন আমাদের মন ও রোগ প্রতিরোধ তন্ত্র পরস্পরের সাথে সম্পর্কিত।

খেয়াল করে দেখবেন মন খারাপ থাকলে শারীরিকভাবে আপনি দুর্বল অনুভব করেন, মাথাব্যথা, পেটব্যথা, সর্দি ইত্যাদি হয়। 

পরীক্ষার সময় টেনশন ডায়রিয়া আমাদের অনেকের কাছেই পরিচিত। অন্যদিকে ইতিবাচক আবেগ আমাদের শারীরিক অবস্থার উপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। নেতিবাচক আবেগ আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে কমিয়ে দেয়।

আপনার এক মিনিটের রাগ পাঁচ ঘণ্টার জন্য আপনার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে দুর্বল করে দিতে পারে। 

কেন রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পায়

বিভিন্ন সূত্র থেকে আমরা জানি, যারা ডায়াবেটিসে ভুগছেন কিংবা যাদের বয়স হয়েছে, ক্যান্সারের রোগী, অঙ্গ প্রতিস্থাপনের রোগী কিংবা যারা কোনো ক্রোনিক রোগে আক্রান্ত তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকে।

এছাড়াও, নানা রকম অসচেতন এবং অস্বাস্থ্যকর অভ্যাস আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে  দুর্বল করে দেয়। এরকম সাতটি অভ্যাস হলো ধূমপান, মদ্যপান, স্বল্প ঘুম, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, শরীরে পানির স্বল্পতা, অলস জীবনযাপন আর মানসিক চাপ ও উদ্বেগে ভোগা।

কিভাবে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করা যায়

তাহলে দেখা যাচ্ছে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তাই মাস্ক, হ্যান্ড স্যানিটাইজার ইত্যাদি ব্যবহারের পাশাপাশি যেটি খুব দরকার তা হলো শক্তিশালী রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলা। আর সেটা হবে তখনই যখন সঠিক খাদ্যাভ্যাস ও পরিষ্কার পরিছন্নতার বাইরেও মানসিক ও আবেগীয় স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত হবে

নিজেকে যত্ন করার মাধ্যমে

শারীরিক উপায় 

স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, পরিমিত ঘুম আর কায়িক পরিশ্রম- এই তিনটি বিষয়কে শারীরিক স্বাস্থ্য রক্ষা আর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে অতিব গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয়। খেয়াল রাখবেন যেন, আপনি আপনার স্বাভাবিক খাদ্যাভাস অব্যাহত রেখেছেন, পরিমাণমতো ঘুমোচ্ছেন আর দৈনন্দিন কিছু না কিছু কায়িক পরিশ্রম করছেন। শারীরিক বিভিন্ন ব্যয়াম করাও খুব কার্যকরি, বিশেষকরে এই সময়ে। 

মানসিক উপায় 

যৌক্তিক চিন্তা

এই সময়ে মানসিক স্থিরতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আপনি যদি ধীরস্থির চিন্তা করতে পারেন, তবে ভুল কম হবে, ফলে সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা কমে যাবে। আর এই মানসিক স্থিরতা আসে যদি আপনি যৌক্তিক চিন্তা করতে পারেন অর্থাৎ আশেপাশের এবং আপনার নিজের বিষয় নিয়ে বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ করতে পারেন। এতে আপনার উদ্বেগ কমে যাবে। 

এই সময়ে অনেক মানুষের হয়ত খাদ্যসংকট চলছে, আপনি একাই সেটা সমাধান করতে পারবেন না। অথবা, মানুষজন নির্দেশ অমান্য করে রাস্তায় বের হচ্ছে, আপনি লাঠি নিয়ে তাদের ধাওয়া করতে বেরিয়ে গেলেন। এরকমটা আসলে মানসিক অস্থিরতায় প্রকাশ করে। আমরা যে সমাজ পরিকাঠামোর মধ্যে আছি, সেই বাস্তবতা বিবেচনা করেই নিজের দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখাটাই আসল কথা। এতে যেটুকু হবে, যেভাবে হবে, সেটাই আসলে আমাদের স্ট্যান্ডার্ড, তাই নয় কি?   

এছাড়া, সামাজিক মাধ্যম বুঝেশুনে ব্যবহার করাও মানসিক স্থিরতার মধ্যে পরে। গায়েবি, আজগুবি এবং অবৈজ্ঞানিক চিকিৎসা বা কার্যকারণ বিশ্বাস করা এবং ভালোভাবে যাচাই না করে শেয়ার করাও কিন্তু মানসিক অস্থিরতা প্রকাশ করে।  

আপনার অনেক অসুবিধা বা সমস্যা হয়তো আছে কিন্তু তারপরেও আপনার যা আছে, যা এখনো উপভোগ করতে পারছেন তার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করুন। অভিযোগ করা থেকে বিরত থাকুন। ঈর্ষা, বিদ্বেষ ইত্যাদি নেতিবাচক বিষয়গুলোকে এড়িয়ে চলুন।

মনোযোগিতা 

প্রতিনিয়িত মৃত্যু আর সংক্রমনের সংখ্যা শুনতে শুনতে আমাদের মন অস্থির হয়ে যায়, উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ি। এই উদ্বিগ্নতা কমাতে মাইন্ডফুলনেস বা মনোযোগী মনের চর্চা করা খুব কার্যকরী। আপনার মন যখন বর্তমানে থাকছে, সেটাই মনোযোগী মন। খেয়াল করুণ, আশপাশের ছোটখাটো বিষয়গুলো, সেগুলো থেকেও আনন্দ নিতে শিখুন । সেটি জানালা দিয়ে গাছে একটি পাখি দেখেই হোক বা আপনার বাচ্চার কোন কথা শুনেই হোক। 

আপনি যত মনোযোগী হবেন, ততই আনন্দ অনুভব করবেন। এতে আপনার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে । প্রতিদিন হাসুন। হাসি, সুখানুভূতি আপনাকে দীর্ঘায়ু করতে ভূমিকা রাখে।

গভীর জীবনবোধ

মনকে স্থির, মনোযোগী করতে হলে, উপরের চর্চাগুলো করার পাশাপাশি কিছু গভীর জীবনবোধের অনুধাবন জরুরি। প্রচলিত ‘আমি, আমি’ বা ‘আমাকেই সেরা হতে হবে, আমাকেই সব পেতে হবে’-এই জীবনবোধ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। মনে রাখবেন, খুববেশি উঁচুনিচু বা বৈষম্য কোথাও বেশিদিন স্থায়ী হয় না। হোক সেটা মানব সমাজে বা প্রকৃতিতে। তাই, নিজের প্রয়োজন মেটানোর পাশাপাশি অন্যকে সাধ্যমত সাহায্য করা, ভালোবাসার প্রকাশ করা, অন্যকে ক্ষমা করে দেওয়া- এসব গুণাবলীর চর্চা করতে হবে। 

ভবিষ্যৎ অজানা, অদেখা কিন্তু বর্তমান সময়ে আমাদের সঠিক পদক্ষেপ আমাদেরকে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যাবে। প্রশান্ত মনই পারে আমাদেরকে সেদিকে নিয়ে যেতে।

ভাল থাকুন সুস্থ থাকুন।

ড. মেহজাবীন হক
অধ্যাপক ও সভাপতি

অধ্যাপক ও সভাপতি

এডুকেশনাল অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Post Author: ড. মেহজাবীন হক

অধ্যাপক ও সভাপতি এডুকেশনাল অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।