আত্মহত্যা না হত্যা

আত্মহত্যা না হত্যা? দায় আসলে কার…

জামা না পেয়ে আত্মহত্যা, প্রেমে ব্যর্থ হয়ে আত্মহত্যা, ধর্ষিত হয়ে আত্মহত্যা- এসব কারণ এখন পুরনো হয়ে গিয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ার অবদানে আত্মহত্যার কিছু নতুন নমুনাও দেখলাম।

ঘটনা-১ 

বেশ কয়েকদিন আগে সোশ্যাল মিডিয়ায় বিড়ালপ্রেমীদের একটা গ্রুপে দেখলাম, এক মেয়ে হাত কেটে আত্মহত্যা করতে চেয়েছে। পরে হাত কেটে তার ছবিটা সে সোশ্যাল মিডিয়াতে প্রকাশ করে। আত্মহত্যা করার কারণ ছিল বাসায় তাকে বিড়াল পালতে দেয়া হচ্ছিল না। বিড়ালগুলোকে সে কাউকে দত্তক দিতে পারছিল না, ফেলেও দিতে পারছিল না। আপন মানুষগুলোকে বুঝাতে না পেরে সে তার মতো পথ বেছে নেয়।

ঘটনা-২

এর কিছুদিন পর দেখলাম এইচ.এস.সি’তে এক বিষয়ে খারাপ করে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে একটি ছেলে। তার সোশ্যাল আইডিতে গিয়ে দেখলাম রেজাল্টের আগের রাতে রেজাল্ট নিয়ে মজা করে কিছু একটা পোস্ট দিয়েছে।  সেই মজা করা ছেলেটিই এক রাতের ব্যবধানে দিনের বেলা তার বিদায় দিয়ে আরেকটা পোস্ট দিলো।

ঘটনা-৩

প্যারানরমাল একটি গ্রুপে দেখলাম, একটি মেয়ে পোস্ট দিয়েছে, সে “সেলফ হারমিং” একটা খেলা খেলতে যাচ্ছে, তার জন্য সকলের দোয়া প্রার্থী। অবাক হয়ে দেখলাম অধিকাংশ মতামত আসছে “আমিও খেলতে চাই” ধরণের। পোস্ট দাতার প্রোফাইল দেখে বুঝালাম উনার নিজেকে ক্ষতি করার একটা ঝোঁক আছে।

অবাক লাগছে, আমাদের দেশের যুবসমাজ এতটা ঠুনকোভাবে গড়ে উঠছে?  দেশে চিত্তবিনোদনের এতই অভাব যে তাদের নিজের ক্ষতি হয় এসব খেলায় মেতে উঠছে?  তারা কী ফ্যান্টাসি আর বাস্তবতার মাঝে পার্থক্য করতে ব্যর্থ হচ্ছে? কেন এমনটা হচ্ছে? কোনো সমাজে যখন অল্প বয়স্ক ছেলেমেয়েরা আত্মহত্যার পথে পা বাড়ায়, তখন বলার অপেক্ষা রাখে না, আমরা কোনো সাঙ্ঘাতিক ভুলের মধ্যে আছি। আমার কিছু অভিমত তুলে ধরছি।

প্রথমত ভাবতে হবে কেন আজকাল ছেলেমেয়েরা এতটা ঠুনকো আবেগিয় অবস্থায় বড় হচ্ছে। অর্থাৎ তারা সঠিকভাবে তাদের আবেগের ব্যবস্থাপনা করতে পারছেনা। এর মূলে রয়েছে কীভাবে পরিবারে তার বিকাশ হচ্ছে। সন্তান লালনপালনে হয়ত এমন কিছু গলদ হচ্ছে যাতে ছেলেমেয়েদের একটি সঠিক এবং দৃঢ় ব্যক্তিত্ব কাঠামো গড়ে উঠছে না। বাবা-মায়ের নিজেদের ব্যস্ততা ঢাকতে গিয়ে সেই ছোটবেলা থেকে বাচ্চাদের হাতে স্মার্টফোন আর ট্যাব তুলে দিচ্ছে। অধিকাংশ সময় বাচ্চা সেই ‘অমানবিক’ যন্ত্রটি নিয়েই পার করছে। আশাপাশে কী হচ্ছে সেদিকে খেয়াল দিচ্ছে না। ফলে গুরুত্বপূর্ণ জীবন দক্ষতা বলতে যা বুঝি সেগুলো তার মধ্যে গড়ে উঠছে না। এক পর্যায়ে যখন তাকে সত্যি সত্যি নানারকম চ্যলেঞ্জের সম্মুখীন হতে হচ্ছে, সে সবকিছু তালগোল পাকিয়ে ফেলছে, এমনকি আত্মহত্যাও করছে।

ইদানিং সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে বাবা-মাদের মধ্যে তুমুল প্রতিযোগিতা দেখা যাচ্ছে। প্রতিযোগিতায় জয়ের মানদ্বন্ড ধরা হচ্ছে, পরীক্ষার ফলাফল তথা গ্রেডশীট। এই গ্রেডশীটের পেছনে ছুটতে গিয়ে কীনা ধকল পোহাতে হচ্ছে, সন্তান আর তার বাবা-মাকে। নিজে যেটা পড়িনি বা বুঝিনি, সমাজের চোখে সন্মানিত হওয়ার জন্য আমরা সেটা বাচ্চাদের মধ্যে চাপিয়ে দিচ্ছি। ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষার কথাই ধরুন। ইংরেজি মাধ্যমে পড়ুয়া অনেক বাচ্চার সাথে পরবর্তীতে বাবা-মায়ের সম্পর্ক ভালো থাকেনা। বাচ্চারা অভিযোগ করে, বাবা-মা তাদের সাথে ইংরেজিতে কথা বলতে পারে না, তারা যে বিষয়ে মজা পায়, সেগুলো নিয়ে আলোচনা করে না। এক কথায় এসব বাচ্চাদের মতে ‘বাসায় আসলে তাদের জমে না’। ফলে দিনে দিনে তাদের মধ্যে কনফিউশন বাড়তে থাকে। জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা তারা হয়তবা মিস করে যায়। অন্যের মনোযোগ আকর্ষণের জন্য সোস্যাল মিডিয়াসহ অনলাইনে নানা ঝুঁকিপূর্ণ উপায় অবলম্বন করে।

আত্মহত্যার মতো ভয়ানক ব্যাধিকে রুখতে হলে, ছেলেমেয়েদের এমনভাবে বড় করতে হবে, যাতে তারা নিজেকে ভালোভাবে বুঝতে পারে তথা নিজের আবেগ-অনুভুতির যথাযথ ব্যবস্থাপনা করতে পারে। এজন্য আগে বাবা-মার মানসিক স্থিরতা বজায় রাখা জরুরি। অর্থাৎ বাবা-মাকে মানসিকভাবে সুস্থ-সবল থাকতে হবে। সেইসাথে, দীর্ঘমেয়াদি ফলাফল মাথায় রেখে শিক্ষা, ক্যারিয়ার এমনকি জীবনসঙ্গী নির্বাচন সংক্রান্ত বিষয়ে সন্তানকে সহায়তা করতে হবে। এবং অবশ্যই আমাদের নিজেদের মতামত চাপিয়ে দিয়ে নয়। এতেকরে তারা পরিবারে নিজের গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারবে, ফলে অন্যের গুরুত্বও বুঝতে পারবে। আর এভাবে হয়তবা আবেগের সঠিক ব্যবস্থাপনা শিখবে, যা তাকে নিজেকে ধ্বংস করার মত কোনো চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত থেকে সরিয়ে আনবে।   

সুরাইয়া জামান
+ posts

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগে অনার্স করে একই বিভাগের ইন্ডাস্ট্রিইয়াল এ্যান্ড অর্গানআইজেশনাল সাইকোলজিতে মাস্টার্স করছি। নিজের সম্পর্কে একটা ঘটনা দিয়ে বলি- কলেজের এক স্যার বলেছিলেন, "আমরা যখন কাউকে এক আঙুল তুলে কথা বলি তখন আমাদের বাকি আঙুলগুলো নিজের দিকে থাকে। নিজের দিকে উঠে থাকা আঙুলগুলোর উত্তর না দিয়ে অন্যের দিকে আঙুল না উঠানো ভালো।"- এভাবেই চলার চেষ্টা করি।

Post Author: সুরাইয়া জামান

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগে অনার্স করে একই বিভাগের ইন্ডাস্ট্রিইয়াল এ্যান্ড অর্গানআইজেশনাল সাইকোলজিতে মাস্টার্স করছি। নিজের সম্পর্কে একটা ঘটনা দিয়ে বলি- কলেজের এক স্যার বলেছিলেন, "আমরা যখন কাউকে এক আঙুল তুলে কথা বলি তখন আমাদের বাকি আঙুলগুলো নিজের দিকে থাকে। নিজের দিকে উঠে থাকা আঙুলগুলোর উত্তর না দিয়ে অন্যের দিকে আঙুল না উঠানো ভালো।"- এভাবেই চলার চেষ্টা করি।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।