তখন আমি সম্মান ২য় বর্ষের ছাত্রী। কিছুদিন যাবৎ খুব মনে হতে লাগলো-‘আমাকে কেউ কোনো কিছুতে ভালো বলছেনা!’। লোকে যেন ভাল বলে সেই মোতাবেক চলার চেষ্টা করতে লাগলাম। নাহ! লাভ হল না! বরং খারাপ লাগা আরো বাড়ল। অন্যকে খুশি করার যত চেষ্টাই করছি, ব্যর্থ হচ্ছি। ফলে দিনে দিনে নিজেকে ছোট মনে হতে লাগলো, কেমন জানি ক্লান্ত বোধ করতে লাগলাম। এক পর্যায়ে এসে অন্যকে খুশি করতে চাওয়া ছেড়ে দিয়ে নিজের দিকে মনোযোগ দিলাম। ছোট ছোট কাজগুলোতে মনোযোগ দিয়ে খেয়াল করলাম আর নিজেকে ধন্যবাদ দিতে শুরু করলাম। দেখলাম, এতে বেশ লাভ হচ্ছে। আস্তে আস্তে আমি পড়াশুনায় ভালো করতে লাগলাম। দৈনন্দিন জীবনযাপনেও তার প্রভাব লক্ষ্য করলাম। আরাম করে একটা ঘুম দিয়ে নিজেকে বলেছি –‘বাহ, বেশ ভাল লাগছে তো!’ ইউনিভার্সিটিতে গিয়েই মজা করে লেবুর সরবত খেয়ে নিজেকে বলছি -‘অনেক শান্তি পেলাম’। এভাবে নিজের যত্ন বাড়িয়ে দিলাম। আস্তে আস্তে উপলব্ধি করলাম, আমার মানসিক অবস্থা আগের তুলনায় ভালো হচ্ছে। ফলে আমি সামাজিক ভাবেও ভাল আছি। নতুন নতুন বন্ধু-বান্ধব আর হাসি-আনন্দে কাটতে লাগলো দিনগুলো। ধীরে ধীরে নিজের যোগ্যতাগুলোকে উপভোগ করতে শুরু করলাম। যেমন-বন্ধু বানানোর ক্ষমতা, পড়াশুনায় মনোযোগ, নিজেকে পরিপাটি করে রাখতে পারা, ইত্যাদি।
নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বুঝলাম, অন্যের স্বীকৃতি সবসময় পাওয়া যায় না। এর জন্য বসে থেকে বা মন খারাপ করে কোনো লাভও হয় না। বরং যতই নেতিবাচক কথা বলব ততই আসলে আমাদের ব্যর্থতার পাল্লা ভারী হয়। নিজেকে ব্যর্থ মনে হয়। হতাশায় ডুবে যাই। একটু খেয়াল করে দেখেন, এই কঠিন সময়ে সব চিন্তাই কিন্তু নেতিবাচক হয় না। ভাল থাকার একটা তাগিদ আছে, বলেই না আপনার মন খারাপ হচ্ছে। তাই নয় কি? আপনার এই সুপ্ত দিকটিকেই কোনো না কোনোভাবে চর্চা করতে হবে, আপনার সচেতনায় নিয়ে আসতে হবে। এটাই হচ্ছে মূল ব্যাপার।
এই চর্চা হতে পারে নিজেকে যত্ন করার মাধ্যমে। নিজেই নিজেকে স্বীকৃতি দেয়ার মাধ্যমে। এটা যে শুধু ওই ব্যর্থ অংশকে সফলতায় রুপান্তর করার জন্য তা নয়, বরং সমগ্র ব্যক্তিকে সামনে এগিয়ে যাবার সাহস যোগানোর জন্য। নিজেকে গ্রহণ করার জন্য। এটা আমরা করতে পারি মনে মনে কতগুলো ইতিবাচক উক্তি আওড়ানোর মাধ্যমে। এটাই হলো আত্ম-স্বীকৃতি।
কেউ কেউ আমরা সচেতনভাবে এটা করি, কেউ কেউ না বুঝেই করি। যেভাবেই হোক না কেন, উপকার কিন্তু হয়ই। আধুনিক গবেষণায় বলা হচ্ছে, নিয়মিত আত্ব-স্বীকৃতি অনুশীলন করলে আমাদের মস্তিষ্কে পুরাতন ভেঙ্গে নতুন রাসায়নিক পথের (নিউরাল পাথ) সৃষ্টি হয়। যা আমাদের আচরণে ইতিবাচক প্রভাব রাখে। যেমন, দেখা গেছে যে ছাত্ররা পড়াশুনায় কম গ্রেড পায়, তাদেরকে বলা হলো তারা যেন নিজেদেরকে আত্ম-স্বীকৃতি দেয় এই বলে-‘আমি পড়াশুনায় ভাল করছি’। পরবর্তী সেমিস্টারে দেখা গেল ওইসব ছাত্রের ফলাফল আগের তুলনায় ভাল হয়েছে। তার মানে নিজের সাথে ইতিবাচক কথা বলা শুরু করার পরে তাদের আত্ম-ধারনার উন্নতি হয়েছে যা তাদের মনোবল ও মানসিক প্রশান্তি বজায় রেখে ভাল ফলাফল করতে সাহায্য করেছে।
এরকম কিছু উক্তি হতে পারে, ‘আমি (আপনার নাম….)। আমি একজন সাহসী মানুষ। আমি পরিশ্রমী। আমি সম্মানিত। আমি একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি’। আরো যোগ করতে পারেন-‘আমি আমার কাজ দিয়ে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রকে সাহায্য করছি’। নিজেকে ধন্যবাদ দিন আরও বলুন ‘সর্বপরি আমি নিজেকে অনেক ভালবাসি’।
অন্যে কখন ভাল বলবে এই অপেক্ষাতে বসে না থেকে নিজেকে নিজে ভাল বলাটা অনেক জরুরি। সেটা শুধু বলার জন্য বলা না। একটু মনোযোগ দিয়ে খেয়াল করুন, আপনার মধ্যে এমন কিছু আছে যা প্রশংসার যোগ্য। অথবা আপনি প্রতিদিন এমন কিছু করেন যা হয়ত কেউ খেয়াল করে না। আমরা সেইসব লুকায়িত দিকগুলোকে সামনে আনতে বলছি। নিজেই নিজেকে ধন্যবাদ দিতে বলছি। নিজেকে ভালোবাসার কথা বলছি। একটু মনোযোগী হোন, ভালোবাসার মতো অনেক কিছুই পাবেন ।
মরিয়ম সুলতানা সুরভি
সাইকোলজিক্যাল কাউন্সিলর,
সাইকোলজিক্যাল হেলথ এন্ড ওয়েলনেস ক্লিনিক (পি এইচ ডাব্লিউ সি)