এক ঝটকায় এত কিছু হয়ে যাবে বিড়ালটা সম্ভবত ভাবতেও পারেনি । এখন অসহায়ভাবে মিউ মিউ করা ছাড়া তার আর কিছুই করার নেই। মিউমিউ করা ছাড়া বিড়ালটা যদি মানুষের মত কথা বলতে পারতো, সে বলতো, ‘আমিতো তোমারই পোষ মেনেছিলাম। তোমার পায়ে পায়েই তো সারাক্ষণ ঘুরঘুর করতাম । তোমার পা দু’টোই তো ছিল আমার আশ্রয়স্থল । তোমার করুণাই ছিল আমার দুধভাত। অথচ আমার মতো এই বাধ্য, অনুগত, নিরীহ গৃহপালিত প্রাণিকে আটকাতেও তোমার বাঁধল না ! এই ছিল তোমার মনে?’
ঘরটিতে আমরা তিনটি প্রানি। দুটো দো’পেয়ে আর একটি চতুষ্পদী। চতুষ্পদী বিড়ালটি কাতর চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে । একজন দো’পেয়ে ঘরের সব দরজা-জানালা বন্ধ করে দিয়েছে। ভাদ্র মাসের পাগলা কুকুরের মত অশান্ত হয়ে আছে। চোখে ক্রোধ। মুখে ড্রাগনের মত হলকা। আর অন্যজন এই বন্দিনাটকের অকর্মণ্য দর্শক! বিড়ালটির ঘোলা চোখে শুরুতে যেরকম কাতর চাহনি ছিল, এখন কাতরতার বদলে করুণা দেখা যাচ্ছে। আমি তাকে করুণা করবো কি, সেই আমাকে করুণা করছে! করুণা করছে আমার নিষ্ক্রিয়তায়, আমার ভোঁতা মানবিকতায়।
বিড়ালটার জন্য পর্যবেক্ষণ করা ছাড়া আমি কি-ই-বা করতে পারি? এর বাইরে কোনো কিছু করার এখতিয়ার আমার নেই, সত্যিই নেই। এর ঘরটির বাইরে, পুরো দেশে, পুরো পৃথিবীতে, এমনকি পৃথিবীর বাইরে কতকিছু ঘটে যাচ্ছে। কে জানে ওই ঘটনাগুলো সম্পর্কহীন অথবা সম্পর্কযুক্ত! কিন্তু এই ঘরটির ভেতরে এই মুহূর্তে একটি মানুষ আর একটি বিড়ালের নিয়তি একই সূত্রে বাঁধা!
ঘটনার শুরুটা স্পষ্ট করা দরকার।
আমি যখন রুমে ঢুকেছিলাম তখন দেখলাম বিড়ালটা তার মনিবের আদর সারা গায়ে মাখছে। আর সোহাগের আতিশয্যে মুখটা বারবার উঁচুতে উঠিয়ে নিচ্ছে।
মানুষ এবং অবোধ প্রাণির এমন ভালোবাসা দেখতে কার না ভালোলাগে? আমার গম্ভীর বিরক্তিমাখা মুখে হাসি ফুটে উঠল।
বাইরে আকাশ ফাটিয়ে বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচতেই এই ঘরটিতে আশ্রয় নিয়েছিলাম । মাথায়, শরীরের জায়গায় জায়গায় বৃষ্টিবিন্দু ছাড়ানোর চেষ্টা করছি আর ওদের মিতালি লক্ষ্য করছি।
হঠাৎ লোকটি ঘরের দরজাটা ঠাস করে বন্ধ করে দিলেন। বিড়ালটা একবার মাথা উঁচু করে শব্দটা ঠাহর করার চেষ্টা করে আবার শান্ত ভঙ্গিমায় শুয়ে পড়ল। দরজা ছাড়া ঘরটির আরো দুটো জানালা। দরজা বন্ধ করে লোকটি চুপিচুপি একটা জানালা তারপর অপর জানালাটি বন্ধ করে দিলেন। এবার ধপধপ পা ফেলে বিড়ালের দিকে এগিয়ে এলেন। বিড়ালটার গায়ে পা দিয়ে মৃদু খোঁচা দিলেন। মৃদু খোঁচাটা এর পরেরবার একটু শক্তি নিয়ে দৃঢ় হল। এবং আলো-আধারি ঘরটিতে নাটক শুরু হল।
বিড়ালটা সচকিত হল। বুঝতে পারছে না কি ঘটছে। কাপড়ে আগুন লাগলে মানুষ যেমন দিগ্বিদিক দৌড়াতে থাকে, বিড়ালটিও সমূহ বিপদের আঁচ পেয়ে দরজার দিকে ছুটে গেল। দরজা বন্ধ। বিড়ালটা দিক পরিবর্তন করে জানালার দিকে এগুলো। জানালাটা দুটোও বন্ধ। পালাবার পথ না পেয়ে বিড়ালটা শান্ত হল। কিন্তু অসহায় মিউমিউ শব্দটা বন্ধ হল না ।
এই মাত্র আদর তো পরক্ষণেই অনাদর ! কেন এমন আচরণ ?
আমি বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছি লোকটির দিকে ।
এইখানে লোকটির বর্ণনা দেওয়া যাক ।
বয়স ৫০ এর উপরে তো হবেই। ২ বা ৩ দিনের খোঁচা খোঁচা মুখভর্তি কাঁচা-পাকা দাঁড়ি। চুল উস্কখুস্ক। পোশাকে একটা যাযাবর যাবাবর ব্যাপার আছে। চোখে অশান্ত ভাব। উৎকণ্ঠা লেগেই আছে। ক্লান্তিকর দুটো চোখ। কি যেন খুঁজে ফিরে বারবার। দীর্ঘদিন ধরে একটা হারিয়ে যাওয়া জিনিস খুঁজে পাওয়ার আশায় পঞ্চইন্দ্রিয় যেমন সর্বদা সতর্ক থাকে, লোকটির পুরো চেহেরায় এমনই একটা বেচেইনি।
বিড়ালটা মিউ মিউ করা ছেড়ে নিয়তি মেনে নিয়েছে। এখন নিথর হয়ে মেঝেতে পড়ে আছে।
লোকটি আমার পাশের চেয়ারে এসে ধপ করে বসলেন। প্লাস্টিকের চেয়ারটা কিছুটা সরে গেল। অনেকক্ষণ ধরে হাঁটার পরে হঠাৎ একটা চেয়ার পেলে যেমন মুখে স্বস্তির দীর্ঘশ্বাস বের হয়, তেমনই একটা লম্বা শ্বাস ছাড়লেন। পকেট থেকে সিগারেট বের করে ধরালেন। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আমি সিগারেট খাই কিনা।
‘না,আমি সিগারেট খাই না,ধন্যবাদ’ দরজা-জানালা বন্ধ তাই দেখবার কোন উপায় নেই বৃষ্টি থেমেছে কিনা। শব্দ শুনে আঁচ করতে পারলাম এখনো থামেনি।
আমি লোকটাকে অপছন্দ করছি না, আবার পাশে বসে সিগারেট টানছে এটাও মেনে নিতে পারছি না।
‘বিড়ালটা আমারই। ১ বছর ধরে সে আমার কাছেই আছে’। বলেই খুকখুক করে কাশতে লাগলেন। কাশির শব্দে বুকে ঘড়ঘড় শব্দ হল।
আমি তক্কে তক্কে আছি প্রশ্নটা করার জন্য । ‘আপনি দরজা-জানালা বন্ধ করে বিড়ালটাকে পেটালেন কেন?’ সুযোগ খুঁজছি। তাই একটু আগ্রহ দেখানোর ভান করলাম।
‘আমি সবসময়ই বাধ্যগত মানুষ ছিলাম। এখনো আছি। ছোটবেলায় আমার প্রভু ছিলেন বাবা। আমার ভাগ্যনিয়ন্তা। প্রচন্ড মেজাজি মানুষ। তাঁর কথার উপরে কথা বলার কোনও সুযোগ ছিল না। আপত্তি সত্ত্বেও মুখে কৃত্রিম হাসি ঝুলিয়ে তাঁর হুকুম তামিল করে যেতে হত।
একটু বড় হলে আমাকে বোর্ডিং স্কুলে দেওয়া হয়। এক প্রভু থেকে মুক্তি পেয়ে এবার অনেক প্রভুর মুখোমুখি দাঁড়াতে হল আমাকে। স্কুল অথরিটি, সিনিয়র ভাই, আর স্কুলের কঠোর নিয়ম-কানুন তো আছেই! এবারেও কোন ইচ্ছা প্রকাশের সুযোগ নেই। যা হুকুম হবে সেটার তামিলই অবশ্যম্ভাবী। বোর্ডিং স্কুলের পাট চুকিয়ে যখন ইউনিভার্সিটিতে প্রবেশের সুযোগ এল, তখনও আমার ইচ্ছার কথা জানাবার সুযোগ ছিল না। ভর্তি হলাম মেডিকেল কলেজে পরিবারের সর্বময় কর্তার ইচ্ছায় ।
মেডিকেলের পড়া আমার ভালো লাগছিল না। তবুও মুখ কামড়ে চালিয়ে যেতে হচ্ছিল। অনাগ্রহের সময়গুলোও থেমে থাকে না। তলে তলে অনেক বেলা হয়ে হল। আমি এমবিবিএস পাশ করলাম। এবার বিয়ের কথা উঠছে। আমাদের পাশের বাড়ির একটা মেয়েকে খুব ভালো লাগত। অবশ্যই তাকে এটা জানানোর সাহস আমার ছিল না। তার বিয়ে হয়ে গেল অন্য আরেকজনের সাথে। আমারও বিয়ে হল আমার বাবার পছন্দ করা এক ডাক্তার মেয়ের সাথে।
এতটুকু বলে লোকটি আরেকটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। আগের সিগারেটটা কখন শেষ হয়েছে খেয়াল করিনি। আরেকটা সিগারেট ধরালেন। সিগারেটের বোটকা গন্ধে ঘর ভরে গেছে। চেয়ার থেকে উঠে গিয়ে দুটো জানালাই খুলে দিলেন।
বৃষ্টি তখনও থামেনি।
চেয়ারে এসে আবার বসলেন। আমি ঘড়ি দেখলাম সকাল ১০ বেজে ১৪ মিনিট।
‘তারপর যা হবার হল। একবার যা শুরু হয়েছে সেটা কি থামানো যায়? আমার ঘরণী আরেক দেবী হিসেবে আবির্ভূত হল। আমার একমাত্র কাজ তাকে পূজা করা। তার বাধা-নিষেধ, ইচ্ছা-অনিচ্ছাগুলো ধর্মীয় গ্রন্থের মত শর্তহীনভাবে মেনে যাওয়াই ছিল তার নিকট আমার নৈবেদ্য!
দুটো বাচ্চা হল। বাচ্চাদুটোর অবস্থাও তথৈবচ। আমার দলে আরো দুটো অনুগত ভৃত্য! ভেতরে ভেতরে প্রচন্ড বিদ্রোহী হয়ে উঠি কিন্তু মুখে প্রকাশের সাহস আমার নাই।
বেলা গড়িয়ে গেল। জীবনাকাশে সন্ধ্যা নেমে এল। সব রাস্তা বন্ধ, তখনও, এখনও। এখন যখন জীবনের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হিসাবনিকাশ করি তখন দেখি প্রাপ্তির পাল্লায় একটা বিরাট শূন্য। অবশ্য এই শূন্যতা দেখা যায় না। ছেলেমেয়ে দুটো একজন ডাক্তার, একজন ইঞ্জিনিয়ার। সবাই প্রতিষ্ঠিত। ঢাকায় নিজেরা বাড়ি করেছে। কোন কিছুর অভাব নাই, শুধু সুখটুকু ছাড়া’।
আমার মুখে সত্যিকারের করুণা ফুটে উঠল ।
‘খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে জীবনের ৬৫টি বছর পার করে এসেছি। এখন এগোচ্ছি মৃত্যুর দিকে। সারাজীবন বিভিন্ন প্রভুর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে সেখানে গিয়ে আরেক প্রভুর মুখোমুখি হবার আশায় বসে আছি, সে যদি অন্তত আমার ইচ্ছার কথা শুনে !’
এ সবকিছুর সাথে একটা বিড়ালকে পেটানোর কি সম্পর্ক বুঝে উঠতে পারছিলাম না ।
‘আমি সারাজীবন একটাই দুঃসাহসী কাজ করেছি। সেটা হল আমার স্ত্রীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিড়ালটাকে বাসায় এনে রাখা। সেটাই আমার সঙ্গী। এমন সঙ্গী, যাকে আমার ইচ্ছার উপর নির্ভর করতে হয়, আমিই যাকে নিয়ন্ত্রণ করি, যার কথা বলার কোনও সুযোগ নাই’
আকাশটা পরিষ্কার হয়ে গেছে। রোদ উঠি উঠি করছে। সবকিছুই এখন পরিষ্কার আমার কাছে। একজন মানুষ গোটা জীবন অন্যের দ্বারা শাসিত হয়ে শেষ জীবনে শাসক হওয়ার বিলাসিতা পোষণ করছে। আর শাসিত প্রাণিটি হল কথা বলতে না পারা, মিউ মিউ করা একটা অবোধ বিড়াল!
রোদ উঠে গেছে। আমাকে অফিসের দিকে ছুটতে হবে। আজকের দিনটি ছাড়া আর কোনদিনই আমার অফিসে পৌঁছাতে দেরি হয় নি। বৃষ্টি না হলে আজকেও সে রেকর্ড অটুট থাকতো। আজকে ১২ টায় একটা জরুরি মিটিং হবার কথা। মিটিং এ অবশ্যই থাকতে হবে।
ঘর ছেড়ে বের হচ্ছি আর ভাবছি আমার প্রভুগুলোর কথা!
হায়, আমিও কি কারো পোষ মানা বিড়াল? দরজা-জানালা বন্ধ করে কেউ কি আমাকে পেটাচ্ছে?
আমারও কি সব রাস্তা বন্ধ?
মিউ…মিউ… কি আমিও করছি না?
ওমর ফারুক
ট্রেইনি ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট। মানুষ নিয়ে ভাবতে ভালোবাসেন । মানুষের কথা শুনতে ভালোবাসেন । মানসিকতার বৈচিত্র্যতায় অবাক হন । মানুষিক বৈচিত্রতায় শব্দ এবং অনুভূতির রঙ চড়াতে পছন্দ করেন। অজানা,অজ্ঞাত, অরূপ বিষয় যা এখনো রহস্য হয়ে আছে সেখানে যুক্তির,মানবিকতার আলো ছড়ানোর প্রয়াসে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ।