নিজের চোখ

ঘুমের গল্প

ব্যাপারটা শুরুতে আমি মানতেই পারছিলাম না । কিন্তু নিজের চোখকে অবিশ্বাসও করা যাচ্ছে না। এটা একটা বিচিত্র অনুভূতি । ঘটনা তোমাকেই ঘিরে, অথচ তুমিই জানো না ঘটনার বিন্দুবিসর্গ !

খুলে বলছি ।

আমাদের বাসায় কাজের মানুষ থাকে না । থাকে না বললে ভুল হবে, আমিই বেশিদিন ধরে রাখতে পারি না । ১-২ মাস যেতে না যেতেই চুরি করতে শুরু করে ।

সেবার বিবাহ বার্ষিকীতে মুহিনকে একটা ঘড়ি উপহার দিয়েছিলাম । খুব দামি। কয়েকদিন পরেই সেটা আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। অনেক খোঁজাখুজি করা হয়েছে । কুসুমকে জিজ্ঞেস করা হয়েছে, গাড়ির ড্রাইভারকেও জিজ্ঞেস করা হয়েছে । তারা নাকি কেউ দেখেইনি । আমরা ঘড়ি চুরির ব্যাপারটা ভুলেই যাচ্ছিলাম কিন্তু একদিন কুসুমের স্বামী তাকে নিতে আসলে দেখি তার হাতে ঘড়িটা! চিনতে আমার একটুও ভুল হয়নি । উৎকট ভাষায় গালাগাল করে বের করে দিলাম।

[আরো পড়ুনঃ ছোট গল্প জাদুর কাঠি]

এরপর থেকে খুব সাবধানি হয়ে গিয়েছিলাম । কাজের বুয়াকে সবসময় চোখে চোখে রাখতাম । কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হল না। যেই লাউ সেই কদু। কাজের বুয়াদের হাতটানের স্বভাব বোধ হয় মায়ের পেট থেকে নিয়ে এসছে। এমন কাউকে পেলাম না যে বলেছে তার কাজের বুয়া কিছু চুরি করে না।

আজকে ৪-৫টা পেঁয়াজ, রসুন, মরিচ তো কাল চিনি অথবা লবণ। এইরকম ছোটখাট জিনিসে চুরিটা সীমাবদ্ধ থাকলে তাও কথা ছিল কিন্তু সোনা-গয়নার মত দামি জিনিসে হাত দিলে কে সহ্য করবে ?

মূল্যবান জিনিসগুলো কোথায় কোথায় রাখি কিভাবে তারা যেন দিব্যদৃষ্টিতে দেখতে পায় !

ঘরে দুটো মাত্র মানুষ, আমি আর মুহিন। দুজনেই ব্যস্ত। মুহিন সেই কোন সকালে বের হয়ে যায়। বাসায় ফিরতে ফিরতে ৭-৮টা বেজে যায়। আমি বের হই ৯টার দিকে। বাসায় ফিরি ৬টায়। বুয়া শুধু দুপুরে এসে ঘরদোর পরিষ্কার করে আর কুকুরটাকে খাইয়ে যায়। রাতের রান্না আমি নিজেই করি।

মাঝের একটা বছর বাদ দিলে গত ৩ বছর ধরে এভাবেই চলছিল আমাদের সময়টা। মাঝের একটা বছরে আমার দুনিয়া উলট-পালট হয়ে দিয়েছে। আমি কেমন যেন হয়ে গেছি। কোনকিছু মন মত না হলে চট করে মাথায় আগুন লেগে যায়। মেজাজ ধরে রাখতে পারি না। ইদানিং অফিসে কলিগরা আমাকে এড়িয়ে চলে। বাসায় এসে কাজের বুয়াকে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগালি করি। মুহিনের সিগারেট খাওয়াটাকে আর সহ্য করতে পারছি না। ছোটখাট বিষয় নিয়ে খুটমাট সবসময় লেগেই আছে। আমরা কেউই বিস্ফোরিত হই না, কিন্তু কোন একদিন হঠাৎ বিস্ফোরণের জ্বালানি যোগান দিচ্ছি প্রতিদিনই ।

সর্বশেষ কাজের মেয়েটা দেখতে শুনতে আগের বুয়াদের তুলনায় একটু বিশ্বাসী। দেখেই কেমন যেন মায়া লাগে। ওর মুখ দেখে মনেই হবে না সে কোনদিন চুরি করতে পারে। সর্ষের ভেতর কিন্তু ভূত থাকে। এই মেয়ে কেন এখনো চুরি করা শুরু করছে না, সেটাই ছিল আমার আশঙ্কা। তবে কি সে বড় ধরণের চুরির মতলব আঁটছে ?

এরইমধ্যে একটা সমস্যা দেখা দিয়েছে। আমি রাতের বেলা হাঁটাহাটি করা শুরু করে দিয়েছি ! স্লিপওয়াকিং যাকে বলে। শুচ্ছি বিছানায় কিন্তু একটা সময় ঘুম ভেঙে দেখি আমি শুয়ে আছি ড্রয়িং রুমের সোফায়। ইনসমনিয়া আগে থেকেই ছিল কিন্তু সেটা এখন গিয়ে দাঁড়িয়েছে স্লিপওয়াকিং এ!

মুহিন শুরুতে খুব আপসেট ছিল ব্যাপারটা নিয়ে। কিন্তু পরে সেও হাল ছেড়ে দিয়েছে। আমাকে কোনভাবেই বিছানায় রাখা যেত না। প্রতিরাত্রেই এমনটা হত তা কিন্তু না। সপ্তাহে তিন কি চার দিন।

ঘুমের সমস্যা, কাজের বুয়ার দুঃশ্চিন্তা, মুহিনের সাথে ঠুসাঠুসি, অফিসের কাজের চাপ সবকিছু মিলিয়ে আমি প্রচন্ড মানসিক চাপে ছিলাম। ভেঙে পড়ছিলাম না যদিও কিন্তু ভেতরে ভেতরে ক্ষয়ে যাচ্ছিলাম।

মুহিন তার এক সাইকোলজিস্ট বন্ধুর সাথে কথা বলেছে।

একদিন আমাকে একরকম জোরাজুরি করে তার কাছে নিয়ে যাওয়া হল।

আমি স্বভাবে খুবই চাপা। সহজে কারো কাছে দুর্বলতা প্রকাশ করি না। কিন্তু মুহিনের বন্ধুর কাছে কেন যেন তোতা পাখির মত গরগর করে সবকিছুই বলে দিচ্ছিলাম। অনেকদিনের জমানো কথাগুলো রেকর্ড ছাড়ার মত করে বের হচ্ছিল।

সব শুনে সে তিনি জানালেন, আমি নাকি প্রচন্ড মানসিক চাপে ভুগছি। ৩ বছর বিয়ের পর প্রথম প্রত্যাশিত বাচ্চা নষ্ট হওয়ার ধাক্কা আমি নিতে পারছিলাম না। যেহেতু বাচ্চাটি ছিল সেই মুহূর্তের চরম আকাঙ্ক্ষিত চাওয়া।

সেখান থেকে সব অনর্থের জন্ম। কাজের বুয়ার প্রতি চুরির অভিযোগ, মুহিনের জীবনাচরণের প্রতি প্রশ্ন তোলা, প্রিয় কুকুরটিকে অবহেলা করা ইত্যাদি সবকিছুই সেই অমীমাংসিত কষ্টের প্রতিক্রিয়া।

কথাগুলো শুনতে এবং মেনে নিতে খুব কষ্ট হচ্ছিল। চোখ ফেটে কান্না বেরুচ্ছিল।

শ্রুতিকটু হলেও কথাগুলো কিন্তু মিথ্যা নয়। নিজেও বুঝতে পারছিলাম, আমি অসহায়তা ঢাকতে গিয়ে অনেক অনর্থের জন্ম দিয়েছি।

কয়েকদিন এভাবে সেশনে কথা বলার পর আমার জীবনটা অনেকটাই সহজ হয়ে উঠল।

সারাদিনের গুমোট এবং ভ্যাঁপসা গরমের পর শেষ বিকেলের বৃষ্টি যেমন স্বত্তির জন্ম দেয়, তেমনি আমিও আমার জীবন দিয়ে স্বত্তি প্রসব করছিলাম ।

কাজের বুয়া নিয়ে সমস্যা কিন্তু কাটেইনি। সেই মায়াবী চেহেরার মেয়েটা তার স্বরুপে ফিরতে শুরু করেছে।

একদিন সকালে বের হবার সময় দেখলাম আমার পার্সটা নেই। আমার পাসপোর্ট, ডায়মন্ডের নোসপিন, অফিস থেকে ইস্যু করা ৫০ হাজার টাকার চেক-আরো প্রয়োজনীয় কিছু কাগজপাতি সবই রয়ে গেছে আমার পার্সে !

আমার তো কপালে হাত। এখন কি হবে? অফিসের টাকাটার জবাব দেই কি করে?

কাজের মেয়েটি এলে তাকে জিজ্ঞেস করি। সে যথারীতি অস্বীকার করে। কষে কয়েকটা ওজনদার চড় বসিয়ে দিলাম গালে। আমি উত্তেজনার শেষ সীমায়। মুহিন অফিস থেকে চলে এল। সে এলে আমাকে শান্ত হতে বলে। মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করল অনেকবার, কিন্তু উত্তর পাওয়া গেল না। মুহিন ঠান্ডা মাথার মানুষ। ভেবেচিন্তে কাজ করে।

সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে যাবে, সবকিছু সে সামলাবে বলে আশ্বাস দিল। আমরা ঘরের উত্তপ্ত হাওয়া থেকে বাইরে বের হলাম একটু শান্ত হবার আশায় ।

ঘটনার এক সপ্তাহ পার হয়েছে। পার্সটা পাওয়া যায়নি। টাকাটা মুহিন দিয়ে দিয়েছে।  কাজের মেয়েটিকে আমি পুলিশে দেবার কথা বলছিলাম কিন্তু মুহিন কেন যেন ও’তে না গিয়ে শুধু বের করে দিয়েছে।

এক মাস পরের কথা। এবারও চুরি। পুকুরচুরি। আলমারি থেকে মুহিনের ৫ লাখ টাকা গায়েব! কাল রাতে ব্যাংকে গিয়ে দিয়ে আসবে বলে আলমারিতে রেখেছিল। বাসায় আমরা দুটো মাত্র প্রাণি। চোর তাহলে কে?

বাসায় আর কোন কাজের বুয়া নেই, আমিও চুরি করিনি, মুহিনের চুরি করার প্রশ্নই উঠে না। নিজে চুরি করে আমাকে ফাঁসানোরও প্রশ্ন আসছে না। সে আমাকে সত্যিই ভালোবাসে। তাহলে চোরটা কে?

হায়, খোদা! এ আমি কি দেখছি?

কম্পিউটার মনিটরে দেখছি আমি আমাকেই। ঘুমঘোরে আলমারি থেকে টাকাটা সরিয়ে আলমারির পেছনে ছোট্ট বাক্সে রেখে দিচ্ছি! এ আমি কি করছি ?

মুহিন বাসায় সিসি ক্যামেরা বসিয়েছে। আমি ক্যামেরায় ধরে পড়ে গেছি। আর সেই বাক্সে ধরা পড়েছে সকল চুরির আদ্যোপান্ত ! যে বাক্সে আমার প্রথম বাচ্চার জন্য কাপড় কিনে রেখেছিলাম ।

ওমর ফারুক
+ posts

ট্রেইনি ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট। মানুষ নিয়ে ভাবতে ভালোবাসেন । মানুষের কথা শুনতে ভালোবাসেন । মানসিকতার বৈচিত্র্যতায় অবাক হন । মানুষিক বৈচিত্রতায় শব্দ এবং অনুভূতির রঙ চড়াতে পছন্দ করেন। অজানা,অজ্ঞাত, অরূপ বিষয় যা এখনো রহস্য হয়ে আছে সেখানে যুক্তির,মানবিকতার আলো ছড়ানোর প্রয়াসে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ।

Post Author: ওমর ফারুক

ট্রেইনি ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট। মানুষ নিয়ে ভাবতে ভালোবাসেন । মানুষের কথা শুনতে ভালোবাসেন । মানসিকতার বৈচিত্র্যতায় অবাক হন । মানুষিক বৈচিত্রতায় শব্দ এবং অনুভূতির রঙ চড়াতে পছন্দ করেন। অজানা,অজ্ঞাত, অরূপ বিষয় যা এখনো রহস্য হয়ে আছে সেখানে যুক্তির,মানবিকতার আলো ছড়ানোর প্রয়াসে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।