তৈরি হতে হতে সোয়া আটটা বেজে গেল মায়ার। ৯টায় ক্লাস। মিনিট ৩০ তো লাগবেই পথে। ডাইনিং এ ঢুঁ মেরে দেখে নিল কিছু আছে নাকি। যাই থাকুক কোন উচ্চবাচ্য করা যাবে না। মা’র অভিযোগ, মায়া শুধু মেজাজ দেখায়। অল্পতেই রাগ করে। পান থেকে চুন খসলেই বেগমের মেজাজ গরম।
না, মা সেরকম কিছুই বললেন না আজকে। পাউরুটির টোস্ট হাতে দিয়ে বললেন, “দেখ মায়া, তুমি রাগ ‘কর’ না, তোমার রাগ হয়। তুমি তো আর অভিনেত্রী নও যে, সময়ে সময়ে রাগ দুঃখের রোল করবে। টয়লেট পেলে কি চুপ করে বসে থাকো? রাগও তেমনি একটা ব্যাপার। বেশিক্ষণ চেপে রাখা ঠিক না। ”
হাইস্কুলের শিক্ষিকা মায়ের কথা শুনে মায়া অবাক। কথাগুলো কী তার মায়ের নাকি অন্যকারো। মায়া ভেবে পায় না।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী মায়া। ব্যবসা প্রশাসনে ৫ম সেমিস্টারে পড়ছে। কলেজে থাকতে শরীরের গড়ন হালকা পাতলা থাকলেও এই দুই বছরে বেশ মুটিয়ে গেছে। তার গায়ের রংটা কেমন জানি বদলে যায়। সকাল সকাল থাকে উজ্জ্বল শ্যামলা, বিকেলে গিয়ে ঠেকে কালোতে। সারাদিন বাসায় থাকলে বেশি তফাৎ হয় না।
বাসা থেকে বেরিয়েই রিক্সা পেয়ে গেল। ঠিক ৫ মিনিট হাতে থাকতেই ক্যাম্পাসে হাজির। পরীক্ষার সময়টুকু বাদ দিলে ছাত্রছাত্রীদের জন্য আনন্দের জায়গা এই ক্যাম্পাস। নিজেদের কিছু হওয়ার আগে ক্যাম্পাসই তাদের নিজস্ব কিছু। নিজেদের বিল্ডিং, নিজেদের ক্যান্টিন, নিজেদের ক্লাসরুম, নিজেদের বাস, নিজেদের মাঠ। তারা বাবার মতো মাথা উঁচু করে ক্যাম্পাসে ঢোকে। মায়ের মতো এদিক-সেদিক তাকায়, সব ঠিক আছে তো? বিল্ডিং, চেয়ার টেবিল, গাছপালা সবাই আনন্দে হেসে ওঠে তাদের দেখে। সবাই বলে, এসো এসো, তোমরা না আসলে আমাদের একদম ভাল্লাগে না! ছাত্রছাত্রীরা হইচই করলে তাদের মন ভরে যায়।
মায়া তাদের মন ভরাতে পারে না। ক্যাম্পাসে এলেই তার মন ভার হয়ে থাকে। তার কারণ ভালো বন্ধু বা বন্ধু সার্কেল বলতে যা বোঝায় সেটা তার এখনও হয়ে ওঠেনি। এই জন্য ক্যাম্পাসে এলেই বুকটা উসখুশ করে। সমবয়সীদের একেকজন একেকভাবে কথা বলে। যদিও টুকটাক কথা হয় সবার সাথে। ফেসবুকে সবাই ফ্রেন্ড।
এই তো গত পরশু কী লজ্জাটাই না দিল ফজলে ছেলেটা। দোতলা থেকে তিনতলা সিঁড়ি বেয়ে ওঠার সময় হঠাৎ মায়া গুনগুণ করে গেয়ে ওঠেছিল হিন্দি গানের কিছু কলি, গান্দি বাদ…গান্দি, গান্দি, গান্দি, গান্দি,……গান্দি বাদ।
ফজলে বিস্মিত সুরে বলল, মায়া? তুমি এসব গান শোন? তোমার মিউজিক্যাল সেন্স তো দেখছি…!
মায়া কিছু বলেনি সেদিন। সে নিয়মিত হিন্দি মুভি দেখে, হিন্দি গান শোনে। ক্লাসের ছেলে মেয়েরা যেসব সিনেমা গান নিয়ে আলোচনা করে তার ধারেকাছেও ভিড়তে পারে না সে। আচ্ছা, আজও কী সিঁড়িতে দেখা হবে ফজলের সাথে? কৌতূহলী মায়া। হ্যা, দেখা হলো।
ফজলে বলল, আরে মায়া, এসে গেছ? স্যার নাকি আজ আধাঘন্টা লেটে আসবে। ভালোই হলো, সকাল সকাল আড্ডা দেয়া যাবে। কী খবর তোমার, বলো?
আমার আর কি খবর থাকবে? অন্যদিকে তাকিয়ে বলল মায়া।
ও বুঝেছি, ঐদিনের কথাতে তুমি মাইন্ড করেছ? আচ্ছা শোন, পাস্ট ইজ পাস্ট। তাছাড়া তোমার পছন্দ অপছন্দ তোমার একান্ত ব্যাক্তিগত। দেখ প্রতিটি মানুষ যেমন আলাদা তেমনি তাদের চয়েসও আলাদা। ফজলে এক নাগাড়ে বলে গেল। মায়া চুপ। একটু দম নিয়ে ফের বলা শুরু করল ফজলে, তুমি আর তোমার পছন্দ এক জিনিস না। তোমার পছন্দের জন্য আমি তোমাকে আলাদা করে দেখতে পারি না। তুমি যা তাই আমার কাছে ইম্পর্টেন্ট।
মায়ার মুখ দিয়ে কথা বের হয় না। এটা স্বস্তি না অস্বস্তি নাকি লজ্জা, কিছুই পার্থক্য করা গেল না। মুখ দেখে মনের কথা বলা মুশকিল। যেটাই হোক ফজলের কথায় মায়ার বেশ লেগেছে।
ধীরে ধীরে তারা দুজন ক্লাশের দিকে গেল। সবাই ছোট ছোট জটলা বেধে গল্প করছে। তিনজন মেয়ের একটি জোট। নুসরাত, জিনিয়া আর শারমিন। দেখতে বেশ সুন্দর। বেশি সুন্দর তাদের পোশাক, গেট-আপ আর কথা বলার ধরন। কোনদিনও তাদের সাথে তাল মেলাতে পারল না মায়া। তাল মেলাতে গেলে কেমন জানি বেতাল হয়ে আরো লজ্জার পরিস্থিতি তৈরি হয়। এই তো সেদিন, কি একটা ড্রেস নিয়ে কথা বলতে চেয়েছিল মায়া। কথা শেষ করার আগেই নুসরাত বলল, বেশি দাম দিলেই যেমন ভালো ড্রেস হয় না, তেমনি ভালো ড্রেস পড়লেই সবাই স্মার্ট হয় না…হাহাহা। কি যে বলবে আজকে এরা? মনে নানা চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে মায়ার।
কাছে যেতেই নুসরাত বলল, মায়া যে, এসো এসো। তোমাকে অনেক ফ্রেস লাগছে আজকে।
না, মানে, আমি… মায়ার কোন বাক্যই পূর্ণ হয় না।
জিনিয়া বলল, আরে এত হেজিটেশনের কী আছে? তুমি ভাবছ আমরা তোমাকে পাত্তা দিই না। তোমাকে নিয়ে হাসাহাসি করি। আসলে, we are not counting you on your dress or get up, but you.
এই মেয়েরা সুন্দর করে কথা বলতে পারে। বিশেষকরে ইংরেজি বলে ঝরঝর করে। আর মায়া যে একেবারে পারে না, তা না। তবে তালগোল পাকিয়ে ফেলে। গত সপ্তাহে এক প্রেজেন্টেশনে তো হি শি নিয়ে যে কী অসুবিধায় পড়েছিল। সবাই হো হো করে হাসছিল। শুধুই কী ইংরেজি? মায়ার জন্ম ও বেড়ে ওঠা জেলা শহরে। সেই জেলার আঞ্চলিক টান তার বাংলাতেও স্পষ্ট। এটা নিয়েও তার মন খারাপ থাকে। আর সেই বিশেষ জেলার জন্য বাড়তি কিছু কথাও জুটে তার কপালে। কিন্তু আজকে কী হবে?
[আরো পড়ুনঃ অনুভূতির অন্তরালে]
শারমিন বলল, আর শোন ইংরেজি নিয়ে মোটেও চিন্তা করো না। এটা হয়ে যাবে। আর কেউ কোন ভাষা কতটা জানল বা কতটা শুদ্ধ করে বলতে পারল, সেটার ওপর ভিত্তি করে কী তাকে দেখা উচিত? আমরা কি তা করছি? করছি না। তুমি যেমন সেটাকেই আমরা সানন্দে গ্রহণ করছি। বস না আমাদের পাশে।
মায়া ভাবে আজকের দিনটি কী বিশেষ কিছু? সবকিছু এত আলাদা লাগছে কেন? এরা কি সত্যি বলছে না ঢং করছে? যাই করুক, তার তো ভালোই লাগছে। চলুক না এরকম ঢং সবসময়।
বসতে গেলেই পেছন থেকে ডাক আসে, এই মায়া, শোন! মায়া চমকে উঠে। গলাটি চেনে সে। এটা তো পিন্টুর গলা। মুরাদ পারভেজ পিন্টু। বইয়ের পোকা। হেন কোনও বই নাই সে পড়েনি। তার সাথে গল্প মানে কিংবদন্তী সব সাহিত্য নিয়ে আলোচনা। ফেসবুকে সে নিয়মিত সিরিয়াস স্ট্যাটাস দেয়। ভার্সিটির স্যারেরাও তার স্ট্যাটাসে আলোচনায় মেতে ওঠে। মায়া শুধু লাইক দিয়েই পার। কমেন্ট করতে পারে না। পারবে কী করে? কথাগুলো কেমন জানি তার মাথার ওপর দিয়ে যায়। পিন্টুদের আলাদা একটা গ্রুপও আছে। পাঠচক্র টাইপ। একদিন পিন্টুর পাশে বসে ক্লাস করছিল মায়া।
পিন্টু বলে ওঠল, মোদিয়ানো পড়েছ? ঐ যে প্যাত্রিক মোদিয়ানো। এবছর সাহিত্যে নোবেল পেয়েছেন।
মায়া হ্যা না কিছুই বলল না, শুধু তাকিয়ে থাকল।
পিন্টু আবার বলল, অথবা গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস এর ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ার্স অফ সলিচ্যুড? পড়নি? আচ্ছা, হেনরিক ইবসেনের নোরা, যেটা তার আ ডলস হাউস থেকে বাংলা অনুবাদ?
এবার মৃদু সরে মায়া বলল, না পড়িনি।
পিন্টু সেদিন মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিল। তার চেহারা দেখে মনে হলো গাধার পালে বসবাস করছে সে। ডানে বায়ে সামনে পিছনে শুধুই গাধাদের দল। ডায়াসের পিছনে যে লেকচার দেয়, তাকেও মাঝে মাঝে বড় গাধা মনে হয়।
সত্যি বলতে মায়া এসব লেখকের নামও ভালো করে শোনেনি। পত্রিকায় এক-দুবার দেখেছিল, মনে করতে পারছে না। পড়া বলতে গেলে হুমায়ুন আহমেদের কিছু উপন্যাস আর দৈনিক পত্রিকার কার্টুন বেসিক আলী। সেদিন পুরোটা ক্লাস পিন্টু আর কোনও কথা বলেনি। শুধু সেদিন না, এরপর থেকে আর কোনদিন পিন্টুদের সাথে মায়ার জমে ওঠেনি।
আজকে পিন্টু ডাকছে কেন? মায়ার মুখ শুকিয়ে যায়। আজ ও কি পিন্টু ওকে ধোলাই দিবে? ছেলেরা যে কেন এমন হয়। মায়া ভয়ে ভয়ে পিছনে তাকায়। পিন্টু বলল, কেমন চলছে তোমার? আজকে সকালে রাস্তা বেশ ফাঁকা ছিল, তাই না?
হুম, বেশ ফাঁকা। আমি তো ১৫ মিনিটে আসলাম।
শোন, তুমি চুপচাপ থাকো কেন? সাহিত্যে তোমার বিচরণ কিছুটা কম, তাতে কী? কে কত বই পড়ে, তার ওপর ভিত্তি করে কাউকে বিচার করা ঠিক না। আগে তুমি মানুষটা, পরে তোমার জ্ঞান। মানুষটাকে আমি বিবেচ্য মনে করছি। এই যে তুমি হাসছ? তোমার হাসিটাতো অদ্ভুদ সুন্দর! কোনদিন খেয়ালি করিনি।
মায়ার বিস্ময় বাড়তে থাকে। কী এমন হলো আজকে? স্বপ্ন দেখছে না তো? একবার চিমটি কাটতে চায়। না থাক, এমন স্বপ্ন না ভাঙা-ই ভালো। ওর ভালো লাগে পিন্টুকে, চুপ করে তার কথা শুনতে। ভালো লাগে স্যারের দেরি করে ঢোকা। স্যার আর একটু দেরি করে আসলে কি হত?
স্যার আসার সময় হতে চলল। কথার ফাঁকে ফাঁকে সবাই দরজার দিকে তাকাচ্ছে। এমন সময় ঢুকলো রুমন মোস্তাফিজ। সাথে তার সঙ্গী আরো তিনজন ছেলেমেয়ে। রুমন রাজনৈতিকভাবে খুবই সোচ্চার গত একবছর ধরে। অনলাইন অফলাইনে সে দারুণ ব্যস্ত। রুমনদের সাথেও মায়ার ভালো কোনও স্মৃতি নেই। একবার না বুঝেই একটি পেজে লাইক দিয়েছিল মায়া। সেটা নিয়ে রুমন বেশ শাসিয়েছিল মায়াকে। সেই ভয়টা আজও আছে মায়ার মনে।
রুমনরা এসে দাঁড়ালো মায়ার পাশে। মায়া আবার চুপচাপ হয়ে তাদের জায়গা দেয়ার জন্য সরে দাঁড়ালো। ১০ চাকার ট্রাককে একটু বেশি সাইড দিতে হয়। রুমন এসেই কথা শুরু করল, কী মায়া? কি খবর? আমি আসলে সেদিন তোমার সাথে বেশি রাফ বিহেভ করেছি। আসলে মানুষ মাত্রই ভিন্ন। ভিন্নতা থাকবেই। ভিন্নতার জন্যই পৃথিবী এত সুন্দর। আমরা তোমাকে তোমার রাজনৈতিক বিশ্বাস কিংবা অবস্থান দেখে জাজ করছি না। একজন মানুষ হিসেবে তুমি কেমন সেটাই দেখার বিষয়, তাই নয় কি?
মায়া আর নিজেকে ধরে রাখতে পারছে না। বুকটা কেমন জানি তুলার মতো হালকা হালকা লাগছে। খুব জোড়ে চিৎকার দিতে ইচ্ছে করছে, এই মানুষগুলো এত ভালো কেন?
এই চেচামেচিতেই ঘুম ভাঙল মায়ার। ঘড়িতে প্রায় দশটা। আজ শুক্রবার। ক্যাম্পাস বন্ধ। মনটা আবার গম্ভীর হয়ে গেল। এতক্ষণ যা ঘটেছে সব স্বপ্ন। মিনিট দশেকের মতো বিছানায় ঝিমালো আর পুরো স্বপ্নটাকে রিওয়াইন্ড করার চেষ্টা করল। যতই ভাবছে ততই খারাপ লাগছে। আহ, স্বপ্ন যদি সত্যি হতো। আমার হাতে যদি যাদুর কাঠি থাকত সবাইকে বদলে দিতাম। বিড়বিড় করে মায়া।
বিছানা ছেড়ে ওয়াশরুমে গিয়ে মুখে পানি ঝাপটালো। বেসিনের সামনের আয়নাতে কেমন যেন কুয়াশা পরেছে। শীত কী আসছে? বা হাত দিয়ে গ্লাসটা মুছতেই ওপাশ থেকে কে যেন বলে ওঠলো, যাদুর কাঠি তোমার হাতেই আছে মায়া। অন্যকে আমরা পরিবর্তন করতে পারিনা, নিজেকে পারি। নিজেকে দিয়েই শুরু কর মায়া। ধারণ কর, যা তুমি অন্যের কাছে প্রত্যাশা কর।
বাথরুম থেকে বের হয়ে জানালার পর্দাটা সরালো মায়া। ফুরফুরে বাতাসে ঘরটা ভরে গেল। চারিদিকে কি মায়া ছড়িয়ে পড়েছে, নাকি ঢাকার বাতাসে অক্সিজেন বেড়ে গেছে? মায়া ভাবতে থাকে।
আজহারুল ইসলাম
কাউন্সেলিং সাইকোলজিস্ট।
সহযোগী অধ্যাপক, এডুকেশনাল এন্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
প্রকাশিত বই