সুবর্ণ এক্সপ্রেস (শেষ পর্ব)- আজহারুল ইসলাম

‘আচ্ছা’ বলেই আজিম সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। আমি একটু হেঁটে আসি। পা ঝিন ঝিন করছে। সাদিয়া বলল, ‘ঠিক আছে।’ সাদিয়া কি আসলে ঠিক আছে? কুঁজো হয়ে সিটে শুয়ে আছে। এত মানুষ ট্রেনের বগিতে, কিন্তু তার একা একা লাগছে। আজিম সাহেব কোথায় গেল? কতক্ষণ লাগবে? সে মাথা উঁচু করে সামনে-পেছনে দেখল। আজিম সাহেবকে দেখা যাচ্ছে না। সাদিয়ার হঠাৎ ভয় লাগছে। ভয় পাওয়া তার স্বভাব না। সে ভয়কে জয় করতে শিখেছে। তাহলে এই অনুভূতিটা কী? অস্থিরতা? সে ভাবতে পারছে না। আজিম সাহেবের ওপর রাগ হচ্ছে। লোকটার মধ্যে অহংকার আছে। কিন্তু কোথায় তিনি? ট্রেনের কয়েকজন যাত্রী টিভি দেখে উচ্চ স্বরে হাসছে। এত হাসির কী হলো? সাদিয়া অবাক হচ্ছে। মানুষের সিভিক সেন্স দিন দিন তলানিতে চলে যাচ্ছে। প্রায় ২০ মিনিট পর আজিম সাহেব ফিরলেন। সাদিয়া বলল, ‘আপনি কি ট্রেনের লাস্ট মাথা পর্যন্ত গিয়েছিলেন?’

না, এই আর কি। একটু হাঁটাহাঁটি করলাম। আমাদের তো আলাপ শেষ হয়নি।

‘আপনিই তো চলে গেলেন। শুরু করেন।’

আচ্ছা, তোমাদের দুজনের একসঙ্গে থাকা ওই দুই মাসকে তুমি এখন কীভাবে দেখছ?

সাদিয়া কিছুটা অপ্রস্তুত হলো প্রশ্নটা শুনে। সম্ভবত এটা নিয়ে সে কোনো দিন ভাবেনি। উত্তরও ঠিক করা নেই। উত্তর দিতে দেরি হচ্ছে দেখে আজিম সাহেব বললেন, মানে আমি জানতে চাচ্ছিলাম তোমার মূল্যায়ন কী?

কী মূল্যায়ন? নাথিং। অপরিণত বয়সের কিছু ফ্যান্টাসি বলতে পারেন।’

খুব স্বাভাবিকভাবেই দেখছ তাহলে?

‘না, কিছু তো গিল্টি ফিলিংস আছে। নিজের প্রতি রাগ হয়। কেন ইম্পালস কনট্রোল করতে পারিনি।’

নিজের প্রতি সেই ফিলিংস কি এতটাই তীব্র যে তোমাকে শান্তিতে থাকতে দিচ্ছে না? তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে?

আজিম সাহেব অপেক্ষা করছেন উত্তরের। তাড়াহুড়োর কিছু নেই। জানেন সাদিয়া সময় নেবে। কিছু প্রশ্নের উত্তরের জন্য নিজেকেই আগে প্রশ্ন করতে হয়। দেন-দরবার করতে হয়। তার জন্য সময় লাগে। পরিবেশ লাগে। আজিম সাহেবের আশঙ্কা এখানে সেই পরিবেশ তৈরি হতে অসুবিধা হচ্ছে।

সাদিয়া নীরবতা ভেঙে বলল, ‘আমি ঠিক বুঝতে পারছি না, স্যার।’

আমি কি সাহায্য করব?

‘প্লিজ।’ সাদিয়া এখন সিরিয়াস দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

আচ্ছা, আমি একটা ওভারঅল পর্যবেক্ষণ বলছি। এটা তোমাকে মানতে হবে তা না। শুধু শোনো।

সাদিয়া মনোযোগী ছাত্রীর মতো বলল, ‘ঠিক আছে, বলেন।’

আজিম সাহেব শুরু করলেন, তোমার একাডেমিক প্রোফাইল অনেক সাফল্যমণ্ডিত। এখন পর্যন্ত প্রায় সব পরীক্ষায় সফল হয়েছ। সাফল্য অর্জন এখন তোমার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। এই যে এত দূর পথচলা এটা আবার কারও করুণায় হয়নি। নকল করে বা ফাঁস হওয়া প্রশ্নে তুমি বিসিএস পর্যন্ত আসোনি। ফলে তোমার মধ্যে একটা সাকসেসফুল এটিটিউড গ্রো করেছে। কিন্তু একটা জায়গায় তুমি পরাজিত। পরির সঙ্গে সেই দুই মাস। যদিও তুমি জাস্টিফাই করতে পারো, পরিকে তুমি অনেক হেল্প করেছ। আজকে তার এই মেডিকেলে পড়ার ভিত্তি হয়তো তুমিই গড়ে দিয়েছ। কিন্তু এটা কখনোই সেই অপ্রত্যাশিত অভিজ্ঞতা দ্বারা কমপেনসেট করা যায় না। সে তখন হয়তো কিছুই প্রকাশ করেনি অথবা বোঝেনি। পরে যখন বিষয়টা ধরতে পেরেছে, তখন তার মনে ঘৃণা জন্মেছে। দুর্জন বিদ্যান হলেও পরিত্যাজ্য এই ভাবসম্প্রসারণ সে নিশ্চয় পড়েছে। তুমি এখন ভাবছ, তাকে মিস করছ? আসলে কি তাই?

সাদিয়া নির্বাক। হ্যাঁ কি না, বোঝা যাচ্ছে না।

আজিম সাহেব আবার শুরু করলেন, আমার ধারণা, তুমি নিজেও ধরতে পেরেছ, কেন পরি তোমাকে এড়িয়ে চলছে। এতে তোমার জেদ বেড়ে যাচ্ছে। তার সঙ্গে একবার দেখা করে ওই ঘটনার জন্য তার মানসিক অ্যাপ্রুভাল চাচ্ছ। তুমি হারা পক্ষের মেয়ে না, জয়ী দলের লোক। পুরো কেরিয়ারে শুধু বিজয় আর বিজয়। কিন্তু একটা ছোট্ট সময় গেছে যেখানে আসলে তোমার জয় নেই। এটা তুমি মানতে পারছ না। ছোট্ট একটার মেয়ের কাছে তোমার সব অর্জন ম্লান হয়ে আছে। আমার সঙ্গে আলাপের উদ্দেশ্য একটি উইন-উইন সমাধান বের করা, তাই না?

সাদিয়ার কণ্ঠ ভার হয়ে আছে। এখন মুখে আওয়াজ করা কঠিন, গলা জড়িয়ে অপরিচিত শোনাবে। সে শুধু মাথা নাড়ল। আজিম সাহেব বললেন, আনফরচুনেটলি তোমার এ ক্ষেত্রে উইন-উইন সমাধান নেই।

সাদিয়ার চেহেরায় স্পষ্ট পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। কপালে রগ ফুটে উঠেছে। মুখ রক্তবর্ণ ধারণ করছে। প্রচুর ঘামছে। যেন একে একে শক্ত দালানের ইট খসে পড়ছে। এতক্ষণ সোজা হয়ে কথা শুনছিল। এখন সিটে হেলান দিয়ে কুঁজো হয়ে আছে। ওড়না একপাশে অনেকটা পড়ে আছে। চোখ পানিতে টলটল করছে। কিছুক্ষণ পরপর লম্বা দম ফেলছে। তার বাতাস আজিম সাহেব পর্যন্ত আসছে। আজিম সাহেব এখন আর কিছু বলছেন না। সাদিয়া সিট পেছনের দিকে ফেলে দিল। দুই পা সিটে তুলে কুঁজো হয়ে আজিম সাহেবের দিকে শোয়ার মতো করে থাকল। তার মনে হচ্ছে ঘুম পাচ্ছে। আবার চোখ দিয়ে পানি ঝরছে। আজিম সাহেব সামনের টিভিতে মনোযোগ দিলেন। একটা নাটক হচ্ছে। বরিশালের ভাষায়। যারা দেখছে তারা বেশ হাসছে। মনে হচ্ছে মজার নাটক। আজিম সাহেব এতক্ষণ খেয়াল করেননি, তাই এখন মাঝপথে কিছুই বুঝতে পারছেন না। সাদিয়া ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে, তার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। আজিম সাহেব তাকাচ্ছেন না। সাদিয়াকে মনে হচ্ছে নিজের বেডরুমে শুয়ে আছে। কিছুক্ষণ পর আজিম সাহেব বললেন, সাদিয়া, ওই গাধা ছেলেটা তোমার দিকে তাকিয়ে আছে।

‘থাপড়াব ধরে।’

তার দরকার নেই। তাকে এখানে ডাকো। বয়ফ্রেন্ড আর কতক্ষণ একা একা থাকবে।

সাদিয়া বলল, আপনি একটা…। বাক্য অসমাপ্ত। কিন্তু এমনভাবে বলল, যেন একটা বিদ্যুৎ তরঙ্গ বয়ে গেল আজিম সাহেবের ভেতরে। এমনটা সচরাচর হয় না। এটা একটা সম্পূর্ণ আলাদা পরিভাষা। শুধু মেয়েরাই পারে এই ভাষা প্রয়োগ করতে। আজিম সাহেব জানালা ধরে বাইরে তাকিয়ে আছেন। গাছ, ঘরবাড়ি শোঁ শোঁ করে পেছনে চলে যাচ্ছে। সুবর্ণ এক্সপ্রেসের গতি মনে হয় বেড়েছে। (সমাপ্ত)

……

সুবর্ণ এক্সপ্রেস গল্পটি আজহারুল ইসলাম-এর ‘হইচই’ গল্পগ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে। আগ্রহী পাঠক হইচই বইটি পেতে পারেন রকমারি ডট কম সহ নিকটস্থ বইয়ের দোকানে।

 

আজহারুল ইসলাম
আজহারুল ইসলাম
+ posts

কাউন্সেলিং সাইকোলজিস্ট।
সহযোগী অধ্যাপক, এডুকেশনাল এন্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

প্রকাশিত বই

হইচই (২০১৯) 
মনোসন্ধি (২০১৭)
জাদুকাঠি (২০১৬) 

Post Author: আজহারুল ইসলাম

কাউন্সেলিং সাইকোলজিস্ট। সহযোগী অধ্যাপক, এডুকেশনাল এন্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। প্রকাশিত বই হইচই (২০১৯)  মনোসন্ধি (২০১৭) জাদুকাঠি (২০১৬) 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।