ট্রেন এখন বেশ দ্রুত গতিতে ছুটছে। যাত্রীদের অধিকাংশ ঝিমাচ্ছে, কেউ কেউ ঘুমিয়ে পড়েছে। আজিম সাহেব নিজেকে গুছিয়ে নিলেন। সাদিয়া নিঃশব্দ। গভীর চিন্তায় মশগুল। আজিম সাহেব বললেন, সাদিয়া, তো আমরা কোথায় ছিলাম?
সাদিয়া নিরুত্তাপ কণ্ঠে বলল, ‘সবই তো বললাম। এখন আপনিই বলেন?’
আজিম সাহেব কিছু বলবেন, সেই কথা দেননি। তাই কিছু না বললেও চলবে। কিন্তু মাথার মধ্যে কেসটা ঘুরপাক খাচ্ছে। মস্তিষ্কের এই একটা সমস্যা। কোনো কিছু দিলে, সেটা নিয়ে নাড়াচাড়া করতেই থাকে। চাইলেই থামিয়ে রাখা যায় না। থামাতে চাইলে বরং অন্য অসুবিধা দেখা দেয়। আজিম সাহেব বললেন,
কী জানতে চাও?
‘পরি কেন আমাকে এড়িয়ে যাচ্ছে? আমিই বা কেন এত কষ্ট পাচ্ছি। সময়ের সঙ্গে অনেক কিছুই সহনীয় হয়ে যায়। আমার ক্ষেত্রে হচ্ছে উল্টোটা। যত দিন যাচ্ছে, তত খারাপ লাগা বাড়ছে।’
আচ্ছা, যতটুকু শুনলাম তাতে কোনো অসংগতি দেখছি না। একটি ছোট মেয়েকে তুমি আদর-যত্ন করে পড়িয়েছ, তার রেজাল্ট ভালো হয়েছে। এখন ভালো প্রতিষ্ঠানে পড়ছে। প্রশ্ন হলো, কেন সে তোমাকে এড়িয়ে যাচ্ছে? সম্পর্কের গাঢ়ত্ব সময় এবং প্রেক্ষাপটের কারণে ফিকে হয়ে আসতে পারে। কিন্তু ইচ্ছা করে কেউ পুরোনো মধুর সম্পর্ককে এড়িয়ে যায় না। আমার মনে হচ্ছে কিছু একটা বাদ পড়েছে। হয়তো তুমি স্মরণ করতে পারছ না অথবা ইচ্ছাকৃতভাবে বলছ না।
সাদিয়া কিছুটা অবাক দৃষ্টিতে বলল, ‘সবই বলেছি!’
শোনো সাদিয়া, তুমি জেনেশুনেই পরিকল্পনা করে আজকে আমার সঙ্গে এই মিটিংয়ের ব্যবস্থা করেছ। বেশ কিছু পয়সাও খরচ করেছ। অর্থাৎ এ কথা বলাটা তোমার কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ।
‘অবশ্যই।’
আমার ধারণা, এ বিষয়টি নিয়ে তুমি আর কারও সঙ্গে আলাপ করোনি।
‘হু।’
তার মানে তুমি আমাকে বিশ্বাস করছ। আস্থা রাখছ?
কিছুটা সময় নিয়ে সাদিয়া বলল, ‘জি, স্যার।’
ভালো। শোনো আমার উদ্দেশ্য কাউকে দোষী সাব্যস্ত করা বা কাউকে বিচারের কাঠগোড়ায় ওঠানো না।
সাদিয়া মাথা নাড়ছে।
আজিম সাহেব বলে যাচ্ছেন, সমস্যার মূলে যেতে হলে নিজেকে সম্পূর্ণ মেলে ধরতে হয়। একজন পেশাদার থেরাপিস্ট একজন বিশ্বস্ত বন্ধুও বটে। গোপনীয়তা রক্ষা করা আমাদের পেশাগত, আইনগত ও নৈতিক দায়িত্ব। সত্যি বলতে কি, অনিচ্ছা সত্ত্বেও তোমার কেসে আমি নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছি। তাই কথাগুলো বলছি।
‘জি স্যার। আপনার পয়েন্ট বুঝতে পেরেছি। আমি আপনার ওপর আস্থা রাখছি। মনে হচ্ছে, আপনার মনে খটকা আছে। আপনি প্রশ্ন করুন, আমি বলছি।’
আজিম সাহেব বললেন, তুমি বুদ্ধিমতী। হ্যাঁ, আমার কিছু জিনিস পরিষ্কার হতে হবে।
‘বলেন, স্যার।’
তোমার বাবা-মায়ের সম্পর্ক কেমন ছিল?
‘ভালো, সাধারণ। উল্লেখ করার মতো কিছু নেই।’
আচ্ছা, তোমরা এখন যে বাসায় আছ, শুরু থেকেই কি একই বাসায় ছিলা?
‘না, শুরুতে আমরা ভাড়া বাসায় থাকতাম। অনেক ছোট, দুই রুমের একটা বাসা। সেখানেই আমার প্রাইমারি স্কুল শেষ করি। আমি যখন সিক্সে তখন আমার মেজো ভাই হয়। এরপর আমরা নিজেদের বাসায় উঠি। প্রথম দিকে ছোট তিন রুমের টিনশেড ঘর বানায় আব্বু। এখন অবশ্য বাসাটা বড় হয়েছে।’
আচ্ছা, তোমার ছোটবেলা কেমন কেটেছে? আই মিন, শৈশবকাল যেটাকে বলে।
‘ভালো। আনন্দেই কেটেছে। মা পড়াত। পড়াশোনার প্রতি ছোট থেকেই আমার আগ্রহ ছিল। বাবা-মা এটা নিয়ে সব সময় গর্ব করত।’
তুমি গর্ব করার মতো মেয়ে। এবার আসি পরি আর তোমার সম্পর্ক বিষয়ে। আজিম সাহেব এখন নিচু স্বরে কথা বলছেন যেন তাদের কথা কেউ না শোনে। সাদিয়াকেও ইশারা করলেন। দুজনে পাশাপাশি ঘাড় ঘুরিয়ে আলাপ চালাচ্ছে।
আজিম সাহেব বললেন, তুমি কী ভেবে দেখেছ, কেন পরিকে এত মিস করছ?
‘জানি না, স্যার। আমি কিছুই জানি না।’ সাদিয়ার কণ্ঠ বালিকার মতো শোনাল।
আজিম সাহেবের চেহারা শীতল হয়ে আসছে। স্থির দৃষ্টিতে সাদিয়ার চোখে তাকিয়ে আছেন। এর মানে তিনি কিছু খেয়াল করছেন অথবা কোনো উত্তর খুঁজছেন। কিছুটা সময় নিয়ে আজিম সাহেব বলা শুরু করলেন, পরি তোমার সঙ্গে তোমাদের বাড়িতে ঠিক কত দিন ছিল?
‘দুই মাসের মতো।’
তোমার সঙ্গেই ঘুমাত?
‘হু, সেটা তো আগেই বললাম।’
আচ্ছা, সেই দুই মাসে পড়াশোনা ছাড়া আর কিছু স্মৃতি আছে তোমাদের?
সাদিয়া চোখমুখ শক্ত করে বলল, ‘হোয়াট স্মৃতি?’
সেটা আমি কীভাবে বলব? তুমি অথবা পরিই বলতে পারবে। যেহেতু পরি আমার সামনে নেই, তাই তোমাকেই বলতে হবে।
‘আমি আপনার কথা বুঝছে পারছি না। কী জানতে চাচ্ছেন?’
মানে দুজন মানুষ একসঙ্গে থাকে তখন অনেক কিছুই ঘটতে পারে। যেমন মজার কোনো ঘটনা, ঝগড়া-বিবাদ বা ভয়ের কোনো কিছু।
সাদিয়া মাথা উঁচু করে ট্রেনের ছাদের দিকে তাকিয়ে ভাবছে। কিছুক্ষণ পর বলল, ‘তেমন কিছুই মনে পড়ছে না। তবে আমরা অনেক মজা করতাম। বিশেষ করে রাতে।’
কী ধরনের মজা? নির্দিষ্ট কিছু মনে আসছে?
‘হুম, এই যেমন, টাচ অ্যান্ড গেস গেইম! ইট ওয়াজ সো ফানি।’
আচ্ছা, কীভাবে খেলতে হয় এই খেলা?
‘সিম্পল, চোখ বন্ধ রেখে কোনো কিছু টাচ করে বলতে হবে জিনিসটা কী। যেমন সে চোখ বন্ধ করত, আমি তার আঙুল আমার গালে টাচ করাতাম। সে বলত কপাল। হা হা।’
ও আচ্ছা। মনে হচ্ছে তুমি বেশ উপভোগ করতে, টাচ অ্যান্ড গেস গেইম।
‘পরিও মজা পেত। তবে অধিকাংশ সময় সে হেরে যেত। এ জন্য কোনো কোনো দিন ঘুমাতে দেরি হতো।’
আজিম সাহেব আরও স্থির হয়েছেন। ট্রেনের ঝাঁকুনিতেও যেন টলছেন না। তিনি বলা শুরু করলেন, সেই টাচ অ্যান্ড গেস গেইম কি তোমাকে কোনোভাবে সেক্সুয়াল প্লেজার দিত?
সাদিয়া চোখ বড় বড় করে বলল, ‘আপনি আসলে কী বলতে চাচ্ছেন?’ দ্রুত চেহারার উজ্জ্বলতা কমে গেল। তার কণ্ঠে উত্তেজনা।
গেইমের একপর্যায়ে হয়তো তোমরা স্পর্শকাতর জায়গা টাচ করছ। খেলার প্রয়োজনে শরীরের বিভিন্ন অপশন ট্রাই করা আর কি। সে তখন ছিল ১২-১৩ আর তুমি ১৭-১৮। অতএব, সেক্সুয়াল সেনসেশন দুজনের মধ্যে গ্রো হওয়ার কথা। পরি প্রথমে বুঝতে না পারলেও ধীরে ধীরে সে আনন্দ পায়। ঘটনা কি এ রকম?
সাদিয়া বেশ রেগে গিয়ে, ‘না, এ রকম না। আপনাদের স্বভাবই হলো সবকিছুতেই সেক্স নিয়ে আসা। আপনার সঙ্গে কথা বলাই ভুল হয়েছে।’ সে মুখ ফিরিয়ে নিল।
আজিম সাহেব বললেন, তুমি বলতে না চাইলে আমরা এখানেই স্টপ করে দিতে পারি। এ প্রসঙ্গ এখানেই বাদ।
সাদিয়া এখন টেবিলে মাথা ঠেকিয়ে চুপ করে আছে। সম্ভবত কাঁদছে। আজিম সাহেব দেখতে পারছেন না। দেখার চেষ্টাও করছেন না। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছেন। দুজনেই নীরব। ট্রেনের শব্দ স্পষ্ট হচ্ছে। টিভির আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। আড়া আড়ি বিপরীত দিকে থাকা ছেলেটি এদিকে অস্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আজিম সাহেবের চোখে চোখ পড়লেই আবার অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছে। মিনিট দশেক পর সাদিয়া মাথা তুলল। চোখমুখ ড্যাব ড্যাব হয়েছে। কিছুটা লালচে দেখাচ্ছে। আজিম সাহেব তার দিকে তাকিয়ে শান্তভাবে বললেন, আমি আছি।
সাদিয়া নাকমুখ মুছল। ‘আসলে স্যার, প্রথমে আমিও বুঝিনি। ওকে মাঝে মাঝে জড়িয়ে ধরতাম। স্রেফ আদর করা। খেলার জন্য বিভিন্ন অংশে টাচ করতাম। তাকেও টাচ করার সুযোগ দিতাম। একদিন খেয়াল করলাম আমার খুব ভালো লাগছে। পরি শুধু বলত ‘সাদি আপু, সুড়সুড়ি লাগছে।’ আর হাসত। আমি আরও অগ্রসর হই। এভাবে প্রতি রাতেই আমরা কিছু না কিছু করতাম। তার শরীরের গন্ধ আমার অনেক ভালো লাগত।’ সাদিয়া কাঁপছে, মনে হচ্ছে তার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।
আজিম সাহেব খুব স্বাভাবিক কণ্ঠে বললেন, জাস্ট রিলাক্স। লম্বা কয়েকটা দম নিয়ে ধীরে ধীরে ছাড়ো। সাদিয়া তা-ই করল।
আজিম সাহেব বললেন, তুমি কি এখনো মেয়েদের প্রতি আকর্ষণ বোধ করো?
‘না স্যার, কী যে বলেন? আমি কি লেসবিয়ান। এরপর কখনোই কোনো মেয়ের প্রতি ফিলিংস আসেনি। পাঁচ বছর তো হলে ছিলাম।’
ছেলেদের প্রতি আছে?
সাদিয়া লাজুক হাসি দিয়ে ‘আছে স্যার। সবই যেহেতু বললাম, বলে ফেলি। আসলে আমার নিজের মধ্যেও সন্দেহ ছিল, আমি কী লেসবিয়ান? নেটে ঘাঁটাঘাঁটি করলাম। লেসবিয়ান ফিল্ম দেখলাম, ঘেন্না লাগল। এখন তো প্রেম করছি, ছেলের সঙ্গে, সিরিয়াস প্রেম।’ (চলবে)
সুবর্ণ এক্সপ্রেস গল্পটি আজহারুল ইসলাম-এর ‘হইচই’ গল্পগ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে। আগ্রহী পাঠক হইচই বইটি পেতে পারেন রকমারি ডট কম সহ নিকটস্থ বইয়ের দোকানে।
একুশে বইমেলা ২০১৯-এ আদর্শ থেকে প্রকাশিত হয়েছে আজহারুল ইসলামের নতুন বই হইচই।
আজহারুল ইসলাম
কাউন্সেলিং সাইকোলজিস্ট।
সহযোগী অধ্যাপক, এডুকেশনাল এন্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
প্রকাশিত বই