গত বছর জানতে পারলাম সে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়েছে। খবরটা শুনে আমার কী যে আনন্দ! সিদ্ধান্ত নিলাম, সরাসরি গিয়ে তাকে সারপ্রাইজ দেব। আড়ং থেকে কিছু গিফট কিনব। জামা কাপড়। সে এখন কত বড় হয়েছে, সাইজ কত, কিছুই তো জানি না। তারপরও অনুমান করে তিন ধরনের তিনটা থ্রি-পিস কিনলাম। সঙ্গে কিছু চকলেট। খবর নিয়েছি, পরি ছাত্রী হোস্টেলে থাকে। দুপুর নাগাদ ফরিদপুর মেডিকেলে পৌঁছালাম। উত্তেজনায় আমার পুরো শরীর কাঁপছিল।
তুমি এখনো কাঁপছ। তারপর কী হলো?
হোস্টেলের গেস্টরুমে বসে আছি। পিয়ন দিয়ে খবর পাঠালাম। সঙ্গে একটা চিরকুট ‘তোমার সাদি আপু’। পিয়ন এসে বলল, ‘খবর দিয়েছি।’
আমি বললাম, ‘সে কি আসছে?’
‘কিছু কয়নি, আপা। বসেন, আইয়া পড়ব।’
আমি বসে থাকলাম, এক ঘণ্টা, দুই ঘণ্টা। কোনো খবর নেই। এরপর ভাবলাম নিজে যাই। যেহেতু আমি মেয়ে, হোস্টেলের ভেতরে যেতে অসুবিধা হলো না। রুম নম্বর খুঁজে পেতে অসুবিধা হলো না। রুমে তিনজন মেয়ে দেখলাম। কেউ বিছানায়, কেউ চেয়ারে হেলান দিয়ে মোবাইল টিপছে। আমি বললাম, ‘আমি পরির কাছে এসেছি।’
একজন বলল, ‘কী নাম? পরির কী হোন আপনি?’
‘আমার নাম সাদিয়া। আত্মীয়। খালাতো বোন।’
‘তাই, কোনো দিন শুনিনি তো।’
আমি বললাম, ‘পরি কোথায়?’
‘সে তো কিছুক্ষণ আগে বের হয়ে গেছে। আপনার সঙ্গে দেখা হয়নি?’ তারা অবাক।
আমি বললাম, ‘না।’
তার রুমে আরও ঘণ্টাখানেক বসলাম। মোবাইল নম্বরে অসংখ্যবার চেষ্টা করলাম, তার বন্ধুরাও কল করার চেষ্টা করল। মোবাইল বন্ধ। শেষে সন্ধ্যা হয়ে আসছে দেখে চলে এলাম। জামাকাপড়সহ গিফট রেখে এলাম। একটা কাগজে আমার ঠিকানা, মোবাইল নম্বর লিখে রেখে এলাম।
ফলশূন্য একটি বিধ্বস্ত দিন গেল তোমার। এরপর কী হলো?
তার সাত দিন পর একটা কুরিয়ার এল আমার কাছে।
জামাকাপড় গিফট ফেরত পাঠিয়েছে?
‘হু।’
কিছু লিখেছিল?
‘আলাদা কোনো চিঠি বা সে রকম কিছুই নেই। শুধু গিফট কার্ডটার উল্টো পাশে ইংরেজিতে লিখেছে, ‘প্লিজ, ডু নট কনটাক উইথ মি। লিভ মি অ্যালোন।’
সাদিয়ার চোখ গড়িয়ে পানি ঝরছে। অনেকক্ষণ ধরে পানি জমেছে, এরপর বড় বড় ফোঁটায় ঝরছে। ট্রেনের ঝাঁকুনিতে চোখের পানি সোজা নিচে না পড়ে গালের এদিক-ওদিক যাচ্ছে।
আজিম সাহেব বললেন, পরি মেয়েটিকে তুমি এখনো কতটা ফিল করো, সেটা বাইরে থেকে আন্দাজ করা আমার পক্ষে কঠিন। তবে সেটা যে অনেক গভীর তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তোমাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে!
সাদিয়া চোখ মুছল। নিজেকে সামলে নিয়ে আজিম সাহেবকে বলা শুরু করল,
‘একটিবার দেখা করলে কী হয়? হাউ কেন আ পারসন ফরগেট এভরিথিং লাইক দিস?’
সাদিয়া প্রশ্নগুলো এমনভাবে করল, যেন সামনে আজিম সাহেব না, পরি বসে আছে।
আজিম সাহেব বললেন, ভুলতে পারেনি বলে সে এড়িয়ে যাচ্ছে আর তুমি তাড়া করে যাচ্ছ।
‘আপনি কি বোঝাতে চাচ্ছেন?’
কিছু না, এমনিই বললাম। যাকগে, আসছি পরে। আমরা কতদূর এলাম?
‘জানি না, আমি কিছুই খেয়াল করিনি।’
তোমার কী খিদা লাগছে?
‘না। আপনি কিছু খাবেন?’
সাদিয়ার কণ্ঠ ভার হয়ে আছে। আজিম সাহেব ভাবলেন, একটা বিরতি নেওয়া দরকার।
ঠিক তেমন খিদা লাগেনি, তবে হালকা কিছু হলে মন্দ হয় না। ইউনিভার্সিটিতে ৩-৪টার দিকে চা-বিস্কুট খাবার টাইম। আজিম সাহেব তার ছোট ব্যাগের চেইন খোলার আগেই সাদিয়া তার প্লাস্টিকের ব্যাগ থেকে দুই প্যাকেট ল্যাক্সাস বিস্কুট বের করল। আজিম সাহেব অবাক হয়ে বলল, তুমি তো দেখছি আটঘাট বেঁধে এসেছ? আমি এই বিস্কুট খাই সেটাও জেনে এসেছ?
‘জি স্যার, আপনার ভোজন তালিকা খুবই সাদামাটা। আসলে আপনি মানুষটা ভীষণ সাদামাটা, কিছুটা খ্যাতখ্যাত-টাইপ।’
আজিম সাহেব বললেন, কথা সত্য। আমি সব সময় খ্যাত থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করি।
আজিম সাহেব, সাদিয়া দুজনে দুটো প্যাকেট ছিঁড়ে বিস্কুট খাচ্ছে। আজিম সাহেবের মুখ থেকে দু-একটা বিস্কুটের টুকরা পড়ে যাচ্ছে। তিনি সেগুলো টুকিয়ে আবার মুখে দিচ্ছেন। আজিম সাহেব খেয়াল করলেন, সাদিয়ার মুখ থেকে কোনো বিস্কুটের টুকরা পড়ে যাচ্ছে না। সে এমনভাবে কামড় দিচ্ছে, শব্দও হচ্ছে না, পড়েও যাচ্ছে না। আজিম সাহেবের বেলায় হচ্ছে উল্টোটা। এটা অভ্যাসের ব্যাপার। আজিম সাহেব মাঝে মাঝে খেয়াল করেন, তার মধ্যে অনেক কিছুর ঘাটতি আছে। ভাবতে ভাবতে আজিম সাহেব আড়াআড়ি কর্নারে থাকা এক যাত্রীকে ইঙ্গিত করে বললেন, দেখছ সাদিয়া, ওই ছেলেটা যে আমাদের দিকে বারবার তাকাচ্ছে? মনে হয় তোমার দিকেই তাকাচ্ছে?
‘কই, খেয়াল করিনি তো? অ হ্যাঁ, তাই তো। লুইচ্চা কথাকার। মনে হচ্ছে গিয়ে কষে একটা থাপ্পড় দিই।’
আজিম সাহেব বললেন, থাক। ঝামেলার দরকার নেই। কার কী উদ্দেশ্য বোঝা বড় মুশকিল। (চলবে)
সুবর্ণ এক্সপ্রেস গল্পটি আজহারুল ইসলাম-এর ‘হইচই’ গল্পগ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে। আগ্রহী পাঠক হইচই বইটি পেতে পারেন রকমারি ডট কম সহ নিকটস্থ বইয়ের দোকানে।

আজহারুল ইসলাম
কাউন্সেলিং সাইকোলজিস্ট।
সহযোগী অধ্যাপক, এডুকেশনাল এন্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
প্রকাশিত বই
- আজহারুল ইসলাম#molongui-disabled-link
- আজহারুল ইসলাম#molongui-disabled-link
- আজহারুল ইসলাম#molongui-disabled-link
- আজহারুল ইসলাম#molongui-disabled-link