কিছুটা সময় নিয়ে আজিম সাহেব বললেন, সাদিয়া, আমার সঙ্গে কী শেয়ার করতে চাও? আর সেটা করে তোমার কী উপকার হবে?
‘আমি একটা ঝামেলায় আছি। জানি না আপনাকে বলে কী হবে। তবে কেন জানি আপনাকে বলতে ইচ্ছে করছে।’
আচ্ছা, আমি তোমার কথা শুনতে পারি। যেহেতু তুমি বলতে চাচ্ছ, তাই শুনছি। কিন্তু কোনো নিশ্চয়তা দিতে পারছি না, তোমার কোনো উপকার হবে কি না। কারণ এই শোনাকে আমি কাউন্সেলিং মনে করছি না। শুধু দুজন মানুষের মধ্যে শেয়ারিং বলা যায়। তুমি কি তাতে রাজি?
‘আমার অসুবিধা নেই। আপনাকে বলেই যদি কিছু হয়।’
আচ্ছা, কী বলবা শুরু করো। বেশি প্যাঁচপ্যাঁচ না করে টু দ্য পয়েন্ট বললে ভালো। একটানা বলে যাও। প্রয়োজন হলে আমি তোমাকে থামিয়ে প্রশ্ন করব।
সাদিয়ার মুখে বিজয়ের হাসি। ‘থ্যাংকু, স্যার। কিন্তু স্যার, কথা থেকে শুরু করব, বুঝতে পারছি না। তালগোল পাকিয়ে ফেলেছি।’
নিজের সম্পর্কে বলা শুরু করো।
‘ওকে। আগেই বলেছি, এখন কী করছি। এই চাকরির আগে আট মাসের মতো একটি ব্যাংকে কাজ করেছি। অনার্স-মাস্টার্স দুটোতেই আমার রেজাল্ট ৩.৫-এর ওপরে। আর ম্যাট্রিক, ইন্টারে গোল্ডেন প্লাস। অর্থাৎ ছাত্রী হিসেবে আমাকে মেধাবী বলা যায়।’
আজিম সাহেব মাথা নাড়লেন।
‘বাসায় মা আছে, অনার্স থার্ড ইয়ারে পড়ার সময় বাবা মারা যান। ও হ্যাঁ, মা শিক্ষিকা ছিলেন। বাবার দোকান ছিল, স্টেশনারি। ভালো চলত। জেলা শহরে আমাদের নিজেদের বাড়ি। আমার ছোট দুই ভাই আছে। একজন অনার্স ফার্স্ট ইয়ারে, ন্যাশনাল ভার্সিটি। আরেকজন এবার এসএসসি দেবে।’
প্রেম, ভালোবাসা, সম্পর্ক?
‘কার? আমার?’
হু।
‘আমার বয়ফ্রেন্ড আছে। তিন বছর হলো। সম্পর্ক ভালো। বিয়ে করব সামনে।’
আচ্ছা, এবার তোমার বর্তমান ক্রাইসিস নিয়ে বলো।
‘ওকে, আমার প্রবলেমটা হচ্ছে একটি মেয়েকে নিয়ে। মেয়েটি এখন মেডিকেলে পড়ে, আমার চেয়ে ছয় বছরের ছোট।’
আজিম সাহেব কৌতূহলী হচ্ছেন। বিস্তারিত বলো।
‘বলছি। তিন বছর ধরে সে আমার সঙ্গে যোগাযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন রেখেছে। এমন কোনো উপায় নেই, চেষ্টা করিনি। তার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারছি না।’
আমি বুঝতে পারছি না। মেয়েটির সঙ্গে তোমার কী সম্পর্ক? শুরু থেকে বলো।
‘আচ্ছা, আমার এলাকায় আমি মেধাবী ছাত্রী হিসেবে বেশ পরিচিত। ক্লাস ফাইভ, এইট দুটোতেই ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পাই। এসএসসির পর কয়েকটি পিচ্চিকে পড়াতাম। মা-ই ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। প্র্যাকটিস আর কিছু পয়সা হবে। সেই পিচ্চিদের একজন হচ্ছে এই মেয়েটি।’
নাম কী? নাম বলা যাবে?
‘আসল নাম বলতে চাচ্ছি না। একটি ছদ্মনাম বলি?’
বলো।
‘ধরেন মেয়েটির নাম পরি। তো পরি তখন ক্লাস ফাইভে পড়ত। ফাইভের বাচ্চা কিন্তু অনেক বড়। খুব একটা মনোযোগী ছিল না। আমি তাকে ধরে ধরে পড়ালাম। পিএসসিতে রেজাল্ট হলো গোল্ডেন প্লাস, সঙ্গে বৃত্তি। আমি কলেজের পড়ায় ভীষণ বিজি হয়ে পড়ায় সব টিউশনি বাদ দিলাম। শুধু পরি আসত। তার বাবা-মা ভীষণ খুশি। কারণ পরি আমার সংস্পর্শে এসে একটির পর একটি ভালো রেজাল্ট করছে। এভাবে চলছে। আমাদের মধ্যে দারুণ বন্ধুত্ব। আমার এইচএসসির শেষ, তার জেএসসি শুরু হবে সামনে। তবে তার প্রিপারেশন অনেক বাকি। হাতে দুই মাস সময় আছে, অথচ এখনো সিলেবাস শেষ হয়নি। আমি বললাম, শুধু দিনে পড়ালে হবে না। রাতেও তাকে গাইড করতে হবে। প্রয়োজনে নোট করে দেব। নিজের বোনের চেয়েও বেশি মনে হতো তাকে। তার ভালো রেজাল্টের জন্য আমারই বেশি চিন্তা হতো। তার বাবা-মাও বুঝল। ঠিক আছে, এই কয়টা দিন সাদিয়ার কাছে থাকুক। সেখান থেকে না হয় স্কুলে যাবে। আমার মা প্রথমে রাজি হয়নি। সম্ভবত বাড়তি খরচের কথা চিন্তা করে। পরে যখন পরির মা বলল, তার বাসায় থাকার জন্য মাসে আরও বাড়তি কিছু টাকা দেবে, তখন মা রাজি হলো। শুরু হলো পরিকে নিয়ে আমার মিশন। স্যার, আপনি কী ঘুমাচ্ছেন?’
হুম, না। সরি। একটানা শুনছি তো। ঝিমানি চলে এসেছিল। আজকে একটু বেশি ভোরে ঘুম থেকে উঠেছি, সে জন্য মনে হয়।
‘আপনি আমার কথা শুনেছেন পুরোটা?’ সাদিয়ার কণ্ঠে বিরক্তির সুর।
পরি একটার পর একটা ভালো রেজাল্ট করছে। জেএসসি পরীক্ষা সামনে। এরপর আর মনে করতে পারছি না। আচ্ছা, দেখি তোমার লিমো পানাস দাও একটু। কতদূর এলাম আমরা?
সাদিয়া চা ঢেলে দিয়ে বলল, ‘কুমিল্লা পার হয়েছি মনে হয়।’
আমি কি অনেক কিছু মিস করে গেছি? বেশিক্ষণ মনোযোগ ধরে রাখা ইদানীং কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে। বয়সের কারণে কি না?
‘না স্যার, বেশি মিস করেননি। পরির ভালো প্রিপারেশনের জন্য সে আমার সঙ্গে আমাদের বাড়িতে থাকা শুরু করল। আমরা দুজনে অনেক খাটাখাটুনি করলাম। সে জেএসসিতেও গোল্ডেন পেল। আমি যেন আমার ছায়া দেখতে পাচ্ছিলাম তার মধ্যে। এরপর সে তার বাসায় চলে যায়, আমিও ঢাকায় চলে আসি, ভার্সিটিতে ভর্তি হই।
যে যার নীড়ে ফিরে গেল। তারপর ‘তাহারা কী সুখেশান্তিতে বসবাস করিতে লাগিল?’ মজার সুরে বললেন আজিম সাহেব।
‘এরপরই তো বিপত্তি দেখা দিল। পরি আমার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দিল। বাসায় ফোন করলেও কথা বলতে চায় না। কী হলো? মানুষ স্বার্থপর মানছি, কিন্তু এতটা? ঈদে-উৎসবে যেখানে অন্তত হাফবেলা সে আমার সঙ্গে কাটাত, এখন ফোনটা পর্যন্ত ধরে না। তার বাবা-মা বলেছে আমি যেন যোগাযোগ না করি। কী অদ্ভুত!’
আমার কাছেও রহস্যময় লাগছে।
‘অনার্সে ভর্তির প্রায় ছয় মাস পর বাড়ি গেলাম। বাড়িতে যাওয়ার দিনই তাদের বাসায় গেলাম।’
কিন্তু গিয়ে দেখলা, পরিরা সেই বাসায় আর থাকে না। কোথায় গেছে কেউ বলতে পারছে না। আজিম সাহেব কথা জুড়ে দিলেন।
‘রাইট। কেউ বলতে পারছে না।’ (চলবে)
সুবর্ণ এক্সপ্রেস গল্পটি আজহারুল ইসলাম-এর ‘হইচই’ গল্পগ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে। আগ্রহী পাঠক হইচই বইটি পেতে পারেন রকমারি ডট কম সহ নিকটস্থ বইয়ের দোকানে।

আজহারুল ইসলাম
কাউন্সেলিং সাইকোলজিস্ট।
সহযোগী অধ্যাপক, এডুকেশনাল এন্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
প্রকাশিত বই
- আজহারুল ইসলাম#molongui-disabled-link
- আজহারুল ইসলাম#molongui-disabled-link
- আজহারুল ইসলাম#molongui-disabled-link
- আজহারুল ইসলাম#molongui-disabled-link