সম্পর্ক ভাঙাগড়ার খেলায় আপনি কী একা?

সম্পর্ক ভাঙাগড়ার খেলায় আপনি কী একা?

বদলে যেতে শুরু করেছে সোহেলীর (ছদ্মনাম) জীবন। রোজ সকালে একজন ঘুম ভাঙ্গাত, ফোন দিয়ে খবর নিত। তার বারান্দায় এখন যে লতা গাছটি ঝুলছে, ওটা তারই দেয়া। সোহেলী স্বপ্ন দেখে, নতুন সংসারের বারান্দায় অনেক গাছ লাগাবে। লতা গাছটির কোল ঘেষে দু’ একটা লাভ বার্ডও রাখবে। এভাবেই কেটেছে দুই বছর। তারপর সেদিন হঠাৎ ছেলেটি না করে দিলো। পরিবার, ক্যারিয়ার, বয়স, এলাকা-ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে সেই চেনা অজুহাত। সোহেলীকে তার বউ করে আনা সম্ভব না!

তাসের ঘরের মতো মুহুর্তেই সব স্বপ্ন ভেঙ্গে গেল। সেদিন সোহেলী প্রচণ্ড মন খারাপ নিয়ে ঘরে ফিরলো। পরিচিত ঘরটা যেন তাকে দম বন্ধ করে মেরে ফেলতে চাইছে। বারান্দার গাছটা বোবা হয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। শীতের বিকেলের কুয়াশা তাকে কী কাঁদিয়েই ছাড়বে? ভেতরে ভেতরে কে যেন কেবল ঝাঁকুনি দিয়ে কিছু একটা বলতে চায়। কি বলতে চায়? সে বোঝেনা। এই অবস্থায় সে কেমন বোধ করছে, কি করবে এখন, কাকে বলবে তার এই উপেক্ষিত হওয়ার ঘটনা, কিছুই ঠাহর করতে পারছে না। নিজেকে অবাঞ্ছিত, অপ্রত্যাশিত মনে হতে লাগলো।

সোহেলীর মতো অভিজ্ঞতা আমাদের জীবনেও ঘটতে পারে। ফলে আমরাও সোহেলীর মতো দুমড়ে মুছড়ে যাই। দিশেহারা বোধ করি। ওই মুহূর্তে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারিনা। নিব কিভাবে, সবসময় যে দ্বিধায় থাকি। আত্ববিশ্বাস কমে তলানীতে ঠেকে, মানুষ চিনতে কতই না ভুল করেছি! অন্যদের কাছে নিজেকে অগ্রাহ্য মনে হয়।

এই ধরনের কোনো পরিস্থিতির সম্মুখীন আপনি। কি করবেন?

পরিস্থিতির যথাযথ মূল্যায়ন করে তা স্বীকার করে নেয়া

হঠাৎ বা অপ্রত্যাশিতভাবে সম্পর্কের অবসান মন কোনোভাবেই মানতে চায় না। যদিও ঘটনা সত্য, মন বলে, ‘না না, সে আবার ফিরে আসবে। এখন যা ঘটছে তা দুঃস্বপ্ন ছাড়া কিছুই না’। এভাবে বাস্তবতাকে অস্বীকার করতে থাকলে কষ্ট দূর হতে সময় লাগবে। অনেক সময় দীর্ঘমেয়াদি বিষণ্ণতায় ভোগার আশঙ্কা থাকে। তাই যত দ্রুত সম্ভব পরিস্থিতির যথাযথ মূল্যায়ন করে তা স্বীকার করে নেয়া ভালো।

অনুভুতিগুলোকেও ‘হ্যাঁ’ বলুন

সেই সাথে তখনকার অনুভুতিগুলোকেও ‘হ্যাঁ’ বলুন। মেজাজ খিটখিটে হওয়া, কান্না পাওয়া, দুশ্চিন্তা হওয়া, ভয় লাগা ইত্যাদি নানা কিছু অনুভব করতে পারেন। এসব নিয়ে বিরক্ত না হয়ে নিজেকে বলতে পারেন,

“আমি একটা খারাপ সময়ের মধ্যদিয়ে যাচ্ছি। এগুলো আমার সাধারণ আচরণ না। এই আচরণগুলো সত্যিকারের আমাকে কোনোভাবেই প্রকাশ করছে না।”

নিজেকে একটু ছাড় দিন

সম্পর্কচ্ছেদের ফলে শরীর ও মনে যে বিশাল ধকল যাচ্ছে তার জন্যও নিজেকে একটু ছাড় দিতে হবে। আগে আপনি দৈনিক যা করতেন, যতটুকু করতেন বা যেভাবে করতেন, এখন হয়ত ঠিক সেরকমটা নাও হতে পারে। এক সপ্তাহ, দুই সপ্তাহ বা এক মাস ধরে হয়ত একটা কিছু নিয়েই বসে আছেন। অসুবিধা নেই। অস্থির না হয়ে বরং ভাবতে পারেন,

“খারাপ লাগার এই সময়টা পার হয়ে গেলেই, সব ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারবেন”।   

ফরমুলা বদলাতে হবে

এই সময়ে মনে হয় জীবন চাকা একেবারে থেমে গেছে। আসলে কিন্তু থামেনি। বরং বলা যেতে পারে এতদিন যেভাবে চলছিলেন, সেটা হয়ত ফলপ্রসূ ছিলনা। একই উপাদান, একই স্টাইলে রান্না করলে যেমন একই রকম স্বাদ হয়, তেমনি হতাশাগ্রস্থ গদবাঁধা আর গতানুগতিক জীবনযাপনেও একই ফল আসবে। সুতরাং ফরমুলা বদলাতে হবে। ভেবে দেখুন, জীবনযাপনের কোন কোন জায়গায় পরিবর্তন আনা যায়।

অন্যের সাথে সম্পর্ক, পছন্দ অপছন্দ, ঘুম খাওয়া, ইত্যাদি কী আগের মতই চলবে?

সামাজিক সহায়তা নিন

মানসিক দুরাবস্থার সময় মনোবিজ্ঞানীরা সামাজিক সহায়তার কথা খুব জোর দিয়ে বলেন। কেননা, সে সময় চারিদিকে মনে হয় অন্ধকার। ফ্লেক্সিলোডের দোকানে যেতেও ভয় লাগে। মনে হয় সব রাস্তা বন্ধ। সব কিছু শেষ। একটু লম্বা দম নিয়ে নীরবে দুই মিনিট স্থির হয়ে কোথাও বসুন। আপনার সামাজিক সার্কেলে অনেক কিছুই খুঁজে পাবেন, যা আপনাকে এই কঠিন সময়টা মোকাবিলা করতে সহায়তা করবে।      

পেশাদার মনোবিজ্ঞানীর সহায়তার কথা ভুলবেন না

সর্বপরি পেশাদার সহায়তার কথা অবশ্যই ভাবতে পারেন। এখন অনেক জায়গায় মানসিক স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে থাকে। এছাড়াও ইদানিং টেলিফোনে কিছু সেবা চালু হয়েছে। পরখ করে দেখতে পারেন।

সম্পর্ক ভাঙাগড়ার খেলায় আপনি যেন নিজেকে কখনই একা না ভাবেন এটাই আমাদের প্রত্যাশা। ভালোমন্দ সব অভিজ্ঞতায় কিছু বার্তা নিয়ে আসে। জীবনকে উপলব্ধি করার জন্য, নিজেকে বোঝার জন্য সেই বার্তাগুলো খুলে খুলে পড়ুন, খুব আদর করে, যত্ন নিয়ে।

হইচই

একুশে বইমেলা ২০১৯-এ আদর্শ থেকে প্রকাশিত হয়েছে আজহারুল ইসলামের নতুন বই হইচই।

মরিয়ম সুলতানা সুরভি
+ posts

সাইকোলজিক্যাল কাউন্সিলর,

সাইকোলজিক্যাল হেলথ এন্ড ওয়েলনেস ক্লিনিক (পি এইচ ডাব্লিউ  সি)

Post Author: মরিয়ম সুলতানা সুরভি

সাইকোলজিক্যাল কাউন্সিলর, সাইকোলজিক্যাল হেলথ এন্ড ওয়েলনেস ক্লিনিক (পি এইচ ডাব্লিউ  সি)

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।