সঙ্গীত আমাদের দৈনন্দিন জীবনের একটি অংশ। এমনকি প্রকৃতির সব কিছুতেই সঙ্গীতের ছোঁয়া আছে। আমরা প্রকৃতিগতভাবেই সঙ্গীত প্রেমিক। এমন অনেক ব্যক্তি আছে যাদের প্রতিদিন গান না শুনলে ভালই লাগে না। বিয়ের অনুষ্ঠান, জন্মদিন, পহেলা বৈশাখ, এমনকি জাতীয় দিবসগুলোতেও সঙ্গীত ছাড়া আমাদের চলেই না। যেখানে জীবনের উৎসব-আনন্দে সঙ্গীত এত গুরুত্বপূর্ণ, সেখানে সঙ্গীত কী আরোগ্য লাভেরও উপায় হতে পারে? মিউজিক কী হতে পারে মনের খোরাক?
দিনে দিনে মানুষ শারীরিক সমস্যার সাথে সাথে মানসিক সমস্যা নিয়েও আগ্রহী হয়ে উঠেছে। সেসব সমস্যা নিরসনে কার্যকরি উপায় খুঁজছে। সঙ্গীত হতে পারে এমনই একটি উপায়। তীব্র ব্যথা, মানসিক চাপ, হতাশা, দুশ্চিন্তা, মুড ডিজওর্ডার, শিক্ষণ জনিত সমস্যা, একাকীত্ববোধ, সমাজ থেকে বিচ্ছিন্নতা ইত্যাদি নানা শারীরিক ও মানসিক সমস্যা নিরসনে সঙ্গীত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। বিশেষজ্ঞরা যাকে বলেন মিউজিক থেরাপি।
মিউজিক থেরাপি আসলে কি?
এক কথায় বলতে গেলে, মিউজিক থেরাপি হচ্ছে শারীরিক ও মানসিক রোগের আরোগ্যের ক্ষেত্রে মিউজিকের বৈজ্ঞানিক ব্যবহার। মিউজিক থেরাপিস্টরা মিউজিকের মাধ্যমে ব্যক্তির আবেগীয় অবস্থা, শারীরিক স্বাস্থ্য, সামাজিক কর্মক্ষমতা, যোগাযোগের দক্ষতা, জ্ঞানীয় ক্ষমতা ইত্যাদি যাচাই করেন এবং ক্লাইন্টের চাহিদার ওপর ভিত্তি করে মিউজিক শোনা, গান লিখা, গানের লিরিক নিয়ে আলোচনা করা, মিউজিক পারফর্ম করা, মিউজিকের মাধ্যমে শিক্ষণ ইত্যাদি পদ্ধতি ব্যবহার করে মিউজিক সেশন ডিজাইন করেন।
দীর্ঘদিন ধরে শারীরিক ও মানসিক ট্রমাতে ভোগা ব্যক্তিদের চিকিৎসায় গুরুত্বপূর্ণ পন্থা হিসেবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই আধুনিক মিউজিক থেরাপির ব্যবহার শুরু হয়েছে। এর প্রেক্ষিতেই ১৯৪৪ সালে মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটি সর্বপ্রথম মিউজিক থেরাপির ওপর ডিগ্রী প্রদান শুরু করে। গ্রীক দার্শনিক প্লেটোও মিউজিকের শক্তি সর্ম্পকে বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন, “মিউজিক একাধারে যেমন যোদ্ধাদের মনোবল বাড়াতে পারে আবার ভাঙ্গতেও পারে।” মিউজিক থেরাপি শুধু রোগীদের ক্ষেত্রেই নয়, সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের মননকে শিথিল করার জন্যও ব্যবহার করা যেতে পারে।
উন্নত বিশ্বে বিভিন্ন সাইকিয়াট্রিস্ট হাসপাতাল, মেডিকেল হাসপাতাল, ডেকেয়ার চিকিৎসাকেন্দ্র, নার্সিংহোম, ড্রাগ ও এলকোহল প্রোগ্রাম, ক্রমবিকাশী অক্ষমতা নিয়ে কাজ করা এজেন্সী এবং বিদ্যালয়ে মিউজিক থেরাপিস্টরা কাজ করে থাকেন।
যেসব ক্ষেত্রে মিউজিক থেরাপি ব্যবহারযোগ্য
ব্যথা কমানো, ক্যানসার রোগীর ব্যবস্থাপনা, স্ট্রোকে আক্রান্ত রোগীদের মনোবল বাড়ানো, হতাশা, ভয়, দুশ্চিন্তা কমানো এবং স্কিজোফ্রেনিক রোগীর চিকিৎসায় মিউজিক থেরাপি ব্যবহার করা হয়। এছাড়াও যেসকল বাচ্চাদের শিক্ষণ জনিত সমস্যা রয়েছে, যারা সহজে নিজেদের মনের কথা প্রকাশ করতে পারে না তাদের ক্ষেত্রেও মিউজিক থেরাপি উপকারী। ধর্ষণের শিকার নারী, যাদের পোষ্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজওর্ডার রয়েছে, তাদের অভিজ্ঞতার সাথে জড়িত কষ্টদায়ক অনুভূতি থেকে মুক্তির জন্য এবং যাদের ভেতর তীব্র আত্মহত্যা করার প্রবণতা রয়েছে তারাও মিউজিক থেরাপি নিতে পারে।
মিউজিক থেরাপি নিয়ে একটি ভুল ধারনা হচ্ছে, ক্লাইন্টের অবশ্যই কোনো না কোনো মিউজিক সম্পর্কিত সক্ষমতা থাকতে হবে। হতে পারে কেউ ভাল গাইতে পারে না, কিন্তু এটা মিউজিক থেরাপি নেয়ার ক্ষেত্রে কোন বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় না। ক্লাইন্টের জীবনে কার্যকর পরিবর্তন আনার জন্য যেকোনো ধরনের মিউজিকই ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে ক্লাইন্টের পছন্দ, চিকিৎসার প্রয়োজন ও পরিস্থিতি এবং ক্লাইন্টের লক্ষ্যের ওপর ভিত্তি করে থেরাপিস্ট মিউজিকের ধরন নির্ধারণ করেন।
নিজে নিজে মিউজিক থেরাপি নেয়া যাবে কি?
হ্যাঁ নিজে নিজেও মিউজিক থেরাপি নেয়া যেতে পারে। দৈনন্দিন জীবনে যখন অনুভূতিগুলো ভোতা হয়ে যায়; রিল্যাক্স করার দরকার হয়; প্রচণ্ড আবেগীয় ও মানসিক চাপ অনুভূত হয়; আত্মহত্যা করার ইচ্ছা জাগে; প্রচণ্ড রাগ অনুভূত হয়; জীবনে একঘেয়েমী চলে আসে; আবেগীয় যেকোনো সর্ম্পকে ভাঙ্গন ধরে, তখন পছন্দের মিউজিক শোনা, বিভিন্ন মিউজিক্যাল যন্ত্র বাজানো, গান গাওয়া, গান চর্চা করা যেতে পারে। ভালো গাওয়া বা সনিপুন বাদ্যযন্ত্র বাজাতে পারাটাই মিউজিক থেরাপির মুখ্য বিষয় না, চর্চা করাটাই আসল।
প্রয়োজন মাফিক নিয়মিত মিউজিক শোনা এবং চর্চা করার মাধ্যমে অনেক সময় মনের গভীরে জমে থাকা কষ্টগুলো বেরিয়ে যায়। মন হালকা হয়। হতাশা এবং দুঃশ্চিন্তা দূর হয়ে মনে ইতিবাচক পরিবর্তন আসে। অনেকসময় গানের কথাও আমাদের মনে শক্তি জোগায়। গবেষণায় দেখা গেছে যে, মিউজিক আমাদের মনোযোগের পরিধি এবং চিন্তাশক্তি অনেকগুণ বাড়িয়ে দিতে পারে। তাই, আপনার বর্তমানকে উপভোগ করতে সঙ্গীতের সহায়তা নিতে পারেন।
একুশে বইমেলা ২০১৯-এ আদর্শ থেকে প্রকাশিত হয়েছে আজহারুল ইসলামের নতুন বই হইচই।
মল্লিকা দে
প্রভাষক
মনোবিজ্ঞান বিভাগ
আই,ইউ,বি,এ,টি বিশ্ববিদ্যালয়
উত্তরা, ঢাকা।