শীতশীত ভাব। রিসায়াতের ঘুম ভাঙল বেশ দেরিতে। ১১.৩০ হবে। উঠতে ইচ্ছে করছে না। উঠে কি হবে? হালকা কিছু খেয়ে ক্যাম্পাসের দিকে যাবে? সেই একই ঢাল তলোয়ার, একই রাজা, একই রানী? ইন্টার পাস করার প্রায় ১০ বছর হলো। ইতোমধ্যে সম্মানের সাথে ডিগ্রী পাস করেছে। তো কী হয়েছে? চাকরি নাই, কাজ কাম নাই। মনে হচ্ছে বিশাল এক বন্ধ্যাত্বতার মধ্যে আছে সে। কিছুই ভাল লাগছে না। কোনো কিছুতে উদ্যম নাই। মনে পরে, স্কুল কলেজের কথা। টেলেন্টপুলে যেদিন বৃত্তির খবর আসল, আহ কী আনন্দ। সবার কী প্রশংসা। নিজের মধ্যে কত্ত সাহস। স্কুল কলেজের পুরোটা সময় কত উৎসাহ নিয়ে পড়াশোনা। কত্ত স্বপ্ন। প্রতিদিন যেন ইঞ্চি ইঞ্চি করে বৃদ্ধি হয়েছে তার। কিন্তু গত পাঁচ বছরে মনে হচ্ছে ঠিক একি জায়গায় থেমে আছে। মাঝে মাঝে এত বিরক্ত লাগে, মনে হয় সবকিছু ছেড়ে অজানা কোথাও হারিয়ে যাবে! যেন তার মধ্যে সে নাই, জীবন চলছে অন্যের নিয়মে!
রিসায়াতের মতো অনেকেরই কোনো এক সময়ে মনে হতে পারে, জীবন থেমে আছে। যতই দিন যাচ্ছে ততই জট লাগছে। জট খোলার নাম নাই। কীভাবে আমরা সেই জট খুলতে পারি, সেরকম তিনটি উপায় আজকে শেয়ার করব। এই পরীক্ষিত তিনটি উপায় আপনাকে আপনার জীবনের জট খুলে আত্ম-নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেতে সাহায্য করবে।
উপায় একঃ রিয়াক্ট ভার্সাস রেসপন্ড
কোনো ঘটনা ঘটলে আপনি কিভাবে তার প্রতিক্রিয়া দেখান? খেয়াল করেছেন কখনও?
কোনো ঘটনায় আপনি কীভাবে সাড়া দেন তা আসলে অনেকখানি ঠিক করে দেয় আপনি কতটা মানসিক প্রশান্তিতে থাকবেন। বিষয়টা ব্যাখ্যা করছি।
ঘটনা ভালো হতে পারে, আবার খারাপও হতে পারে। সেটা আপনার জীবন ঘনিষ্ঠ কিছু হতে পারে অথবা সমাজের কিছু একটি হতে পারে। যাই ঘটুক, প্রতিটি ঘটনাই আপনার মনকে প্রভাবিত করে।
যেমন, ভালো ঘটনায় আপনি আনন্দিত, উচ্ছ্বসিত হয়ে যান। আবার, খারাপ কিছু ঘটলে আপনি হতাশায় ভোগেন, রাগান্বিত বোধ করেন, বিরক্তিতে ফেটে পড়তে পারেন।
এই দুই ক্ষেত্রেই আপনার প্রতিক্রিয়া খুব দ্রুতই হয়।
ভালো ঘটনায় আপনার প্রতিক্রিয়া হতে পারে,
বাহ, কী দারুণ ব্যাপার!
কত ঝাক্কাস পারফরমেন্স!
কি চমৎকার বলিং/ব্যাটিং!
অসাধারণ নৈপূণ্য!
অপরদিকে, খারাপ ঘটনার বেলায়, আপনার মাথায় আসতে পার,
সব অপদার্থের দল!
সব নষ্টদের দখলে চলে গেছে!
চোরে ভরে গেছে দেশ!
মানুষ এত গাধা কেন!
নীতি নৈতিকতার কিছুই অবশিষ্ট নেই!
খেয়াল করে দেখেন, দুই ক্ষেত্রেই আমরা দ্রুতই একটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌছাচ্ছি। এটাকে বলা হয়, ‘রিয়াক্ট করা’ বা অবচেতন মন থেকে খুব দ্রুতই প্রতিক্রিয়া করা। এক্ষেত্রে কোনো গভীর চিন্তা না করেই অনেকটা হুট করেই সিদ্ধান্ত চলে আসে। এর ফল আসলে ভালো হয় না। কেননা, এই দ্রুত প্রতিক্রিয়া করতে গিয়ে আমরা বস্তুনিষ্ট বা নিরপেক্ষ থাকতে পারি না। যেহেতু পর্যাপ্ত তথ্য উপাত্ত থাকেনা, ফলে রিয়াক্ট করতে গিয়ে আমাদের পূর্ব ধারনা বা ভুল ধারনাগুলো সামনে চলে আসে। এতে সমস্যা সমাধান তো হয়েই না বরং হতাশা আর ঘৃণা বাড়তে থাকে।
বলা হয়ে থাকে, আপনি যখন রিয়াক্ট করেন তখন আপনি আপনার ক্ষমতা অন্যের হাতে দিয়ে দেন, আপনি আত্মশক্তি হারিয়ে ফেলেন। পক্ষান্তরে, যদি রেসপন্ড করেন, আপনি নিজের নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতেই রাখেন (বব প্রক্টর)।
‘রিয়াক্ট করার’ পরিবর্তে আমরা ‘রেসপন্ড’ করতে পারি।
আচ্ছা, তাহলে আরেকটি শব্দ পেলাম, ‘রেসপন্ড করা’। রেসপন্ড করা মানে কী?
রেস্পন্ডিং হচ্ছে, ঘটনার সাথে সাথেই অটোমেটিক কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে, পরিস্থিতি মুল্যায়ন করে সচেতনভাবে গঠনমুলক সিদ্ধান্ত নেয়া।
খেয়াল করুন, রিয়াক্টিং হচ্ছে অটোমেটিক্ প্রতিক্রিয়া আর রেস্পন্ডিং হচ্ছে সচেতন প্রতিক্রিয়া।
আপনি যখন রেসপন্ড করবেন, ঘটনার সাথে আপনার কী ভুমিকা তা ধরতে পারবেন। ফলে পরিস্থিতি আপনার নিয়ন্ত্রণে থাকবে। আপনি রেসপন্ড করছেন মানে ঘটনাকে আপনার জীবনের সাথে মিলিয়ে দেখছেন।
মুস্তাফিজের বলিং বা তামিমের ব্যটিং দেখে শুধু হাততালিই দিচ্ছেন না, ভেবে দেখছেন, আপনার নিজের জীবনের খেলায় আপনি কতটা দক্ষতার সাথে বলিং করছেন, কতটা ধৈর্য্যের সাথে ব্যাটিং করছেন। সেটা যখন আন্দাজ করতে পারছেন, সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিচ্ছেন।
বৃষ্টিতে রাস্তা ডুবে যাচ্ছে, আপনি শুধু অন্যকে দোষারোপ করেই যাচ্ছেন না, ভাবছেন, আপনি নিজে কি রাস্তায় প্লাষ্টিকের বোতল, প্যাকেট যেখানে সেখানে ফেলে গেছেন?
নারীর প্রতি সহিংসতার খবর দেখে শুধু ফেসবুকে জ্বালাময়ী স্ট্যাটাস দেননি, আপনি নিজে কোনোভাবে নারীকে, হতে পারে পরিবারে, কর্মক্ষেত্রে বা রাস্তায়, হেও করে কোনো কাজ বা কোনো বৈষম্যমুলক ধারণা পোষণ করেন কিনা সেটা ভেবে দেখেছেন।
রিয়াক্ট না করে রেসপন্ড করার একটি ঐতিহাসিক উদাহরণ হলো ভারতের বিহার রাজ্যের দরিদ্র দশরথ মাঝি। নিঃস্ব হতদরিদ্র এই মানুষটি একাই এক বিশাল পাহাড় কেটে রাস্তা তৈরি করেছিলেন। ফলে ৫৫ কিমি রাস্তা না ঘুরে মাত্র ১৫ কিমি পথ দিয়েই গ্রামের মানুষ শহড়ে গিয়ে সেবা নিতে পারছে। হাজারও বাঁধা এসেছিল তার জীবনে, সমস্যার কোনো শেষ ছিল না, কিন্তু তিনি প্রতিক্রিয়া দেখাননি, রেসপন্ড করেছেন। ২০১৫ সালে তার জীবন নিয়ে একটি মুভি হয়েছে, ‘মাঝি, দি মাউন্টেনমেন’।
মূলকথা হলো, রিয়াক্ট করলে কোনো লাভ হয় না, রেসপন্ড করলে হয়।
তো আমরা দেখছি, নানা উপায়ে রেসপন্ড করা যায়।
সবচেয়ে শক্তিশালি আর কার্যকর রেসপন্ড কী হতে পারে? যেকোনো অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি বা খারাপ সময়ের মোকাবিলায় যেটা সবচেয়ে কার্যকর হবে?
এটাই হচ্ছে আজকে আমাদের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ উপায়।
উপায় দুইঃ নিজেকে নিয়মিত আপডেট করা
হ্যাঁ, বাংলায় বললে নিজেকে হালনাগাদ করা। নিজেকে প্রতিনিয়ত আপডেট করাই আসলে সকল প্রতিকুলতার বিরুদ্ধে রেসপন্ড করা।
আপনি আপডেট হবেন, শারীরিকভাবে, মানসিকভাবে, বুদ্ধি দিয়ে, অর্থনৈতিকভাবে, সামাজিকভাবে।
২০১৮ সালের আপনি আর ২০১৭ সালের আপনি এক হওয়ার কথা না। তেমনি ২০১৬, ২০১৫, ২০১৪ থেকে আপনার লক্ষনীয় আপডেট হওয়ার কথা। যদি একই থাকেন, আপনার কোনো আপডেট হয়নি।
২০১৮-তে এসে আপনি ২০১৫’র কোনো মডেলের মোবাইল বা ডিভাইস কিনবেন কি?
নিজেকে আপডেট করার ক্ষেত্রে দুইটি অপ্রিয় সত্য আছে।
এক) সফটওয়ার বা মোবাইল অ্যাপ্স অটো-আপডেট হওয়ার সুযোগ আছে। দুর্ভাগ্যবসত মানুষের বেলায় এরকম কোনো ব্যবস্থা নেই। আপনাকে ম্যানুয়ালি তথা নিজের প্রচেষ্টায় আপডেট হতে হবে।
দুই) কোনো ডিভাইস ইন্ট্যাক ফেলে রাখলে তেমন কোনো ক্ষতি হয় না। কিন্তু মানুষ যদি আপডেট না হয়, ক্ষতি হবার আশঙ্কা রয়েছে। ভেবে দেখুন, এক বছর ধরে আপনি কোনো বই পড়ছেন না, গান শুনছেন না, মুভি দেখছেন না, প্রিয় জায়গায় বেড়াতে যাচ্ছেন না, আপনার বিশ্বাসের রীতিনীতি চর্চা করছেন না, কায়িক পরিশ্রম করছেন না, কেমন থাকবেন আপনি?
শারীরিকভাবে দুর্বল হলে অন্যায় মেনে নেয়ার প্রবণতা দেখা যায়।
মানসিকভাবে দুর্বল ব্যক্তি প্রতিবাদ করার সাহস পায় না।
অর্থনৈতিক স্বাবলম্বি না হলে আত্মমর্যাদা ধরে রাখা কঠিন হয়ে পরে।
সুতরাং এখন পর্যন্ত কী দাঁড়াল?
যেকোনো পরিস্থিতিতে রিয়াক্ট না করে রেস্পনড করা উত্তম।
আর সবচেয়ে কার্যকর রেস্পন্ড হচ্ছে, নিজেকে প্রতিনিয়ত আপডেট করা। এখন প্রশ্ন হলো, নিজেকে প্রতিনিয়ত আপডেট করার উপায় কী?
এই প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে আজকে আমাদের তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ উপায়। সহজ এবং খুবই কার্যকরি উপায় আছে। শুধু একটা কাজ করবেন..
উপায় তিনঃ দিনের কাজ দিনেই শেষ করুন
হ্যাঁ, প্রতিদিন আপনার যেই কাজ সেটা যেন ঐ দিনেই শেষ করেন। ব্যস।
শুনতে সাধারণ মনে হলেও এটাই আসলে সবচেয়ে কার্যকরি কৌশল।
দিনের কাজ যেকোনো কিছুই হতে পারে। কারো জন্য হয়তবা নতুন কোনো প্রজেক্ট শুরু করা আবার কারো জন্য শুধুমাত্র সময়মত গোসল করা (আপনার কী ধারনা, সবাই সময়মত গোসল করতে পারে?)। প্রতিদিন সকালে ঠিক করবেন, আজকে সারাদিন আপনার কী কী কাজ। রাতে ঘুমাবার আগে সেই কাজের লিস্ট মিলিয়ে দেখবেন। যদি সব হয়ে যায়, সেদিনের জন্য আপনি আপডেট।
এভাবে যদি চলতি পারেন, এক সপ্তাহ পর দেখবেন, কতগুলো কাজ করে ফেলেছেন। এক মাস, ছয় মাস, এক বছর পর কী অবস্থা হবে কল্পনা করতে পারেন?
তাই সবকিছু ঝেড়ে দিন, এমনকি এই লেখাও পড়া বন্ধ রেখে চিন্তা করুন, আজকের দিনের কাজটি বা কাজগুলো কী করা হয়েছে?
ফরমুলা একটাই, আজকের দিনের কাজটা কী করা হয়েছে?
অতীতের হতাশা বা ভবিষ্যতের দুশ্চিন্তা নয়, শুধুই বর্তমান এবং ঠিক এই মুহূর্তে আজকে কী কাজ? সেটা কি করেছি? করা হলে সাব্বাস!
১৫ দিন এভাবে দিনের কাজ দিনে শেষ করার খেলা খেলুন, দেখবেন, হতাশা, অস্থিরতা, উদ্বেগ হাওয়ায় মিশে গেছে। জীবনের জট খোলা শুরু হয়েছে, ধীরে ধীরে নিয়ন্ত্রণ আপনার হাতেই চলে আসছে। আর সেই অনুভুতি একেবারেই অন্যরকম।
আবার যদি সংক্ষেপে বলি, জট খোলার তিনটি উপায় হলো,
এক) রিয়াক্ট নয় রেসপন্ড করার অভ্যাস করতে হবে।
দুই) সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রেসপন্ড হচ্ছে নিজেকে আপডেট রাখা।
তিন) নিজেকে আপডেট রাখার কার্যকর পদ্ধতি হচ্ছে দিনের কাজ দিনেই শেষ করা।
আশা করছি, বিষয়গুলো ব্যাখ্যা করতে পেরেছি। আপনার নিজের অভিজ্ঞতা কী? কী কৌশলে আপনি জট খুলতে পারেন? আমাদের সাথে শেয়ার করুন।
আজহারুল ইসলাম
কাউন্সেলিং সাইকোলজিস্ট।
সহযোগী অধ্যাপক, এডুকেশনাল এন্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
প্রকাশিত বই