১৯, ০, ৯৫, ২, ১৩, ২৫
তামিম ইকবালের ২০১৫ বিশ্বকাপের ছয়টি ইনিংসের রান। কোনো ম্যাচে খারাপ খেললে ঠিক এভাবেই ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেখা যায়। ‘ট্যালেন্টেট ব্যাটসম্যান, শুধু ধারাবাহিকতার অভাব।’
ক্রিকেট খেলা অনেক কিছু সহজ করে দিয়েছে। মানুষ সহজে বুঝতে পারে ক্রিকেটে ধারাবাহিকতা কী, সাফল্য অর্জনে ধারাবাহিকতার গুরুত্ব কত।
সমস্যা হলো অন্যের সমস্যাটা আমাদের চোখে সহজে ধরা পড়ে। কিন্তু একই ঘটনা আমাদের নিজেদের জন্য কোথায়, কীভাবে প্রযোজ্য তা নজরে আসে না।
তামিম ইকবালকে বকাঝকা দেওয়ার পর কি কারও মনে হয়, তামিমের ধারাবাহিকতা নেই, আচ্ছা আমার কী আছে? আমি যে লক্ষ্য ঠিক করেছি তা বাস্তবায়নে ধারাবাহিকভাবে কাজ করে যাচ্ছি তো? তামিমের ধারাবাহিকতা না থাকলে দলের জন্য খারাপ হয়, আমার নিজের ধারাবাহিকতা না থাকলে কী হবে?
শত শত তরুণ-তরুণীর সাথে নিবিড়ভাবে কাজ করছি, নিজের সাথেও লড়াই করছি। ফলাফলে দেখলাম, সাফল্য লাভের জন্য কঠিন, নতুন কোনো ফরমুলা নেই। সেই যে শিয়াল আর কচ্ছপের গল্প ছোটবেলায় পড়েছি, সেটাই যথেষ্ট। শিয়ালের মতো শুধু গতি থাকলেই গন্তব্যে পৌঁছানো যায় না, কচ্ছপের মতো ধারাবাহিকভাবে এগিয়ে যেতে হয়।
মেধায় তুখোড় অসংখ্য ছাত্রছাত্রী দিনশেষে তেমন কিছুই করতে পারে না। অথচ সাধারণ মানের মেধা নিয়েও শুধু ধারাবাহিকতার জন্য জীবনে এগিয়ে গেছে। যা চেয়েছে তা-ই পেয়েছে। জন্মগত মেধাবী বা জিনিয়াস বলতে কিছু নেই। মেধাবী মাত্রই অধ্যবসায়ী। প্রতিদিন একটু একটু করে যা করবেন তাই আপনার আগামী, আপনার পরিচয়। আলাদিনের চেরাগ ছাড়া রাতারাতি কিছু একটা বনে যাওয়ার চিন্তা করাটা নিতান্তই বোকামি।
বছরের শুরুতেই প্রায় সবাই লক্ষ্য ঠিক করে, এই বছর কী কী অর্জন করতে চায়। সে অনুযায়ী কাজও শুরু করে। কিন্তু এক-দুই সপ্তাহ পরে কোথায় যেন হারিয়ে যায় সেই উদ্যম। আমরা বলি, যে-ই লাউ সেই কদু। স্বাস্থ্য যা ছিল তা-ই আছে, অথবা খারাপ হয়েছে। অর্থকষ্ট রয়েই গেছে। গবেষণা পেপার এখনো সম্পাদকের কাছে যায়নি। স্বপ্নের চাকরিটা এখনো চায়ের দোকানের আড্ডার মধ্যেই সীমাবদ্ধ আছে। জীবনটাও চলছে ঢিমেতালে। ফুর্তি লাগে না কিছুতেই। আনন্দ-উৎসব ভালো লাগছে না। বন্ধুরা ফেসবুকে এত বিয়ের ছবি দেয় কেন, বিরক্ত লাগছে! অ্যাকাউন্ট ডিএকটিভেট করে দেব।
জিজ্ঞেস করি, কেমন যাচ্ছে দিনকাল?
আ আ…র আমার দিনকাল!
বেশি কিছু যেন আর শোনার চেষ্টা না করি তারই ইঙ্গিত।
সাফল্যের জন্য স্বপ্ন দেখা জরুরি, স্বপ্ন পূরণের জন্য দরকার যথার্থ পরিকল্পনা, আর পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য দরকার কাজ করা। হ্যাঁ, কাজ করা এবং সেটা প্রতিদিন। প্রতিদিন অল্প অল্প করে এগোলে সাফল্য আসবেই। এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।
একটা হিসাব দিচ্ছি। আপনার বয়স যদি এখন তিরিশ হয়, তবে এখন পর্যন্ত আপনি কমপক্ষে ৫১ মণ চালের ভাত খেয়েছেন। হ্যাঁ, ঠিক পড়েছেন, ৫১ মণ চালের ভাত, তাও আপনি একাই খেয়েছেন! হিসাবটা খুব সহজ। প্রথম দুই বছর বাদ দিয়ে ২৮ বছর প্রতিদিন গড়ে অন্তত ২০০ গ্রাম চালের ভাত খেয়েছেন ধরলে, তিরিশ বছরে এসে দাঁড়ায় ৫১ মণ চালের ভাত।
উদাহরণটা বেখাপ্পা লাগলেও সত্য। একইভাবে আপনার যেকোনো লক্ষ্য নির্ধারণ করে অল্প অল্প করে প্রতিদিন কাজ করে যান, আগামী ৫, ১০ বা ২০ বছর পর ৫১ মণ চালের মতোই বিশাল কিছু হয়ে যাবে।
এই বইয়ের (জাদুকাঠি বইয়ের কথা বলেছি) জন্য মোট ২৫৫০০ শব্দ লিখতে হয়েছে। এটা কি এক দিনে হয়েছে? আমার পরিকল্পনা ছিল, প্রতিদিন অন্তত ২০০ শব্দ লিখব, চার মাসে লেখা শেষ হবে। বাস্তবে তারও আগেই শেষ হয়েছে। একেবারে ২৫৫০০ শব্দের কথা ভাবলেও কেমন জানি এলোমেলো লেগে যায়। কিন্তু দিনে ২০০ শব্দ, গায়েই লাগে না। ফেসবুকের স্ট্যাটাসও অনেক সময় এর থেকে বেশি বড় হয়। আপনি নিজের ফেসবুক স্ট্যাটাসগুলো একবার যোগ করে দেখেন।
প্রতিদিন কাজ করার ফলে সেটা আপনার অভ্যাসে পরিণত হবে। আমার এক ছাত্রী যখন অনার্স-মাস্টার্স সব পরীক্ষায় প্রথম হলো, তার বন্ধুরা লিখেছে, প্রথম হওয়া তো তোর অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। হ্যাঁ, কথাটা একেবারে সঠিক। ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের গবেষকরা বের করেছেন, একটানা ৬৬ দিন কোনো কাজ করলে তা আমাদের ব্রেইনে স্থায়ীভাবে ইনস্টল হয়ে যায়। সেটা একটা অভ্যাসে পরিণত হয়। একটু খেয়াল করে দেখেন, যে কাজটি এখন আপনি অবলীলায় করতে পারছেন, সেই কাজটি একদিন আপনার জন্য কত কঠিন ছিল।
ধারাবাহিকতা বজায় রাখার পাঁচটি উচ্চমাত্রার প্রতিষেধক
১। মূল্যায়ন করুন পরে, আগে কাজটা করে ফেলুন
পরিকল্পনামাফিক কাজ করতে গেলে মনের পাখিটা বড় বাধা হয়ে আসে। বলতেই থাকে, কেমন হলো? নাহ, হচ্ছে না! বিচ্ছিরি! ধমক দিয়ে মনের পাখিটাকে থামিয়ে দিন। কোয়ালিটি যেমনই হোক, কাজ করে যান। যদি লেখেন, তবে লিখেই যান। মূল্যায়ন করার যথেষ্ট সময় পাবেন পরে।
২। ঘুম থেকে উঠেই ঠিক করে ফেলুন আজ কী করবেন, কতটুকু করবেন
হ্যাঁ, সকালে বিছানা থেকে উঠেই ঠিক করে ফেলুন, আজ কী করতে চান। কতটুকু করতে চান। ভালো হয়, এক-দুই লাইনে আপনার ডায়েরিতে লিখে ফেলুন। রাতে ঘুমানোর আগে আবার সেই লেখাটা পড়ুন।
৩। অজুহাত ছুড়ে ফেলুন, কাজে নেমে পড়ুন
আজ শুক্রবার, বাসায় মেহমান আছে, বাংলাদেশের খেলা দেখাচ্ছে টিভিতে, হরতাল, শরীরটা ভালো লাগছে না, কম্পিউটার নষ্ট, নেট কানেকশন নেই ইত্যাদি হাজারো অজুহাত সব সময় প্রস্তুত থাকে আপনাকে লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করার জন্য। সাবধান, এসব খোঁড়া অজুহাতের পাল্লায় পড়বেন না। যে অজুহাতে আপনি আজ ঝিম ধরে বসে আসেন, অন্যজন কিন্তু ঠিকই তার কাজটা করে ফেলেছে। অজুহাতকে যত পাত্তা দেবেন, সে ততই পেয়ে বসবে।
৪। রাতারাতি বাজিমাতের স্বপ্ন না
একটা যদি সুযোগ পেতাম, দেখায়ে দিতাম আমি কী জিনিস। আফসোস সেই সুযোগটাই পাচ্ছি না। দুনিয়াটা বড়ই কঠিন! এরকম রাতারাতি বাজিমাতের অলীক স্বপ্ন দেখা বন্ধ করুন। পৃথিবীতে আজ পর্যন্ত কোনো অর্জনই রাতারাতি হয়নি। সাফল্যের শর্টকাট পথ নেই। ধীরে ধীরে এগোতে হবে। শর্টকাটে বড় করা জিনিস আপনি নিজেও পছন্দ করেন না। কী করেন, ফার্মের মুরগি অথবা ইনজেকশন দিয়ে মোটাতাজা করা গুরু ছাগলের মাংস?
৫। ফলাফলের জন্য নিজেকে দোষারোপ করবেন না
রাতারাতি কিছু হয় না, ফলে অনেকে নিজেকে বারবার দোষারোপ করে। পারছি না কেন, হচ্ছে না, আমার দ্বারা হবে না, আমি একটা গর্ধভ। দয়া করে এমনটা করবেন না। প্রতিদিন যে কাজটুকু হয়েছে, পরিকল্পনামাফিক এগিয়েছেন, সেটার জন্য নিজেকে অনেক অনেক ধন্যবাদ দিন। ফল আসবেই। একটু ধৈর্য ধরুন। নিজেই নিজেকে দোষারোপ করবেন না। আপনার সবচেয়ে আপন বন্ধু আপনি নিজে। সেই বন্ধুর পাশে থাকুন। বিজয় নিশ্চিত।
মূল কথা হলো, সাফল্যের জন্য ধারাবাহিকভাবে কাজ করে যেতে হবে। যে বিষয়ে আপনার গভীর আগ্রহ সেটা নিয়ে লেগে থাকেন, দেখবেন কত সহজে তা আপনার হাতে ধরা দিচ্ছে।
নেপোলিয়ান হিলের কথায়, সাফল্য মানুষের হাতে ধরা দেওয়ার জন্য মুখিয়ে আছে। শুধু আপনার ডাকের অপেক্ষা।
তাই, সাফল্যের জন্য বসে না থেকে কাজ করা শুরু করে দিন। এখনই। একটু একটু করে। হয়ে উঠুন মি. ডিপেনডেবল।
নোটঃ লেখাটি মানসিক প্রশান্তি আর সাফল্যের জাদুকাঠি বই থেকে নেয়া।
সহকারি অধ্যাপক, এডুকেশনাল এন্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়