এবারের গরমটা মনে হয় একটু বেশিই পড়েছে। ঝলসানো সূর্যটা বেশ কড়াসরা ভাবেই দো্যখী তাপ দিয়ে যাচ্ছে। ভরদুপুরে ঘামতে ঘামতেই হাসপাতালের লিফটে উঠলাম। হাসপাতাল আমার তেমন একটা পছন্দ নয়। ফিনাইলের গন্ধে মাঝে মাঝে নাকটা যেন কেমন মুচরে আসে।
পাঁচতলা আসতেই বেলের টুং আওয়াজ করে লিফটের দরজা খুলে গেল। রোদ্রে ভেজা ঘাম মাখা শরীরেই হনহন করে হাটা দিচ্ছি ৫১২ নম্বর কেবিনের দিকে। আমি রায়াত, বাবার ইচ্ছে ছিল ডাক্তারি পড়ব, কতশত মানুষের প্রাণ বাঁচাব তাদের পাশে থাকব। ডাক্তারি পেশা আমার পছন্দ নয়। তাই বলে ডাক্তারদের যে অপছন্দ তা কিন্তু নয়। রক্ত ছুরি কাচি এগুলোতে আমার বেশ ভয়। বর্তমানে একটি বৃদ্ধাশ্রমে বিশেষ দায়িত্বে আছি। মানুষের পাশে থেকে তাদের দুঃখগুলোকে অনুভব করে নিজের সাথে ভাবতে অদ্ভুত লাগে। কত বিচিত্র মানুষের জীবন, কত বিচিত্র তাদের ভাবনা! বেমালুম উপরের উনি ছাড়া আর কেউ এই খেলাগুলো সাজাতে পারেন না।
[আরো পড়ুন তোমার ঘরে বসত করে কয়জনা]
৫১২ নাম্বার কেবিনে এখন যাচ্ছি সালমা খালাকে দেখতে। আমাদের বৃদ্ধাশ্রমেই তিনি ছিলেন। প্রায় আড়াই বছর হল উনি আমাদের এখানে আছেন। গত কাল রাতে হাঁপানির যন্ত্রনা বাড়ায় উনাকে হাসপাতালে আনা হয়েছে। রাতেই অক্সিজেন দেয়া হয়েছে, এখন কিছুটা সুস্থ আছেন।
৫১২, একটু ধাক্কা দিতেই ভারি কাঠের দরজাটা খুলে গেল। কপালে ভাঁজ পড়া ৫৬ বছরের সালমা বেগম চোখ বন্ধ করে ঘুমাচ্ছেন। খরগোসের মত সাদা চাদরের বিছানায় হেংলা পাতলা শরীরটা পড়ে আছে। পাশ থেকে চেয়ারটা টেনে বিছানার কাছে বসতেই ক্লান্ত চোখের পাতা খুলে আমার দিকে তাকালেন। কত্তো গভীর সেই চোখের কষ্ট, কত রঙের মায়া আর ক্ষোভের বাস ছোট্ট এই চোখ জোড়ায় । কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থেকে উনার হাতটার উপর হাত রাখলাম। আর অমনি যেন বন্যার মত পানি ঝড়তে লাগল উনার চোখ ছাপিয়ে। কষ্টে মনে হয় পাজরের হাড় গুলোও ছিড়ে বেরিয়ে আসবে।
অদ্ভুত মায়া আমাদের সম্পর্কটাতে। প্রায় ১৫ মিনিট হয়ে এলো আমি এসেছি কিন্তু আমাদের এখনো কোনো কথা হয়নি, অমনই বসে আছি। নিঃশব্দে পাশে বসে থাকাটাই যেন এই মুহূর্তে স্বর্গীয় শান্তি মনে হচ্ছে।
যার ভাগ্য শেষ হয়ে যায় তাকে নাকি হতভাগী বলে! এই বৃদ্ধাকে কি বলা যায় বুঝতে পারছিনা। দুই ছেলে মেয়ে বেঁচে থাকলেও উনাকে বৃদ্ধাশ্রমে থাকতে হচ্ছে! ছোট ছেলে কানাডায় আর বড় মেয়ে পাষণ্ড স্বামীর সাথে নরকের সংসারে দিন-যাপন করছে। গেল বার রোজার ঈদের পর মেয়েটা এসেছিল মাকে দেখতে এরপর আর কোনো খোঁজ খবর নেয় নি।
আজ সকালে কানাডায় ছেলেকে ফোন করে অসুস্থতার কথা জানানো হয়েছে। প্রতিমাসে বৃদ্ধাশ্রমের খরচের টাকা পাঠায় আর তখন আমার ফোনে মায়ের সাথে ৪-৬ মিনিট কথা হয়! কী কথা হয় উনাদের মাঝে জানিনা, উনি শুধু হুম হুম করেই কথা বলে আর কিছু না। শেষে ভাল থেকো বলেই ফোনটা রেখে দেন! অথচ কী অদ্ভুত আমার সাথে উনার কথা বলা শুরু হলে আর থামতেই চায় না। দীর্ঘ দম ছেড়ে ছেড়ে জীবন খাতার সব গল্পই উনার বলা হয়ে গেছে আমার সাথে। হয়ত নিজ ছেলের বেলায় সময়ের স্রোতে অনুভূতির জাহাজটা বেশ পাল্টে গেছে!
খুব বেশি কি কষ্ট হচ্ছে এখন? প্রশ্নের উত্তরে ভেজা চোখে মুচকি হাসি হেসে বৃদ্ধা বললেন বেশ কিছুক্ষণ হল আমার মনের কষ্ট গুলো চলে গেছে বাবা। তবে শ্বাস নিতে বুকের ভিতর বেশ কিছুটা চাপ লাগে!

কামরুন নাহার খান পিন্নী
ট্রেইনি এডুকেশনাল সাইকোলজিস্ট, এডুকেশনাল এন্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ভাল লাগে নতুন কিছু ভাবতে ও নতুনের সাথে পরিচয় হতে। আর ইচ্ছে করে প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে যেতে।
- কামরুন নাহার খান পিন্নী#molongui-disabled-link
1 thought on “অনুভূতির অন্তরালে”
Raju
(সেপ্টেম্বর 27, 2018 - 9:23 অপরাহ্ন)ভালো লাগলো। ধন্যবাদ।