আমরা প্রায়ই অভিযোগ করি, “পড়তে বসলেই দুনিয়ার চিন্তা মাথায় আসে”! ব্যাপারটা যে শুধু পড়তে বসলেই ঘটে, এমনও না। এমন প্রচুর উদাহরণ কিংবা অভিজ্ঞতা আছে যে- আমরা যখন একটি কাজ শুরু করি, তখন সেই কাজে পুরোপুরি মনোযোগ দিতে পারি না। অন্যান্য নানান অগোছালো চিন্তা আমাদের মনকে গ্রাস করে রাখে। মনের আকাশে নানা ধরনের চিন্তার মেঘ ভেসে বেড়ায়।
এতে করে হয় কি- আমাদের মূল কাজের প্রডাক্টিভিটি বাধাপ্রাপ্ত হয়। যে কাজটি একঘন্টায় শেষ হওয়ার কথা, সেটা শেষ হতে হয়তো তিন-চার ঘন্টা লেগে যায়। কিংবা কাজটির গুণগত মানে তার প্রভাব পরে। আজকাল ফেসবুকের দরুণ আমরা প্রচুর ফার্স্ট হ্যান্ড অভিজ্ঞতা বা উদাহরণ পাব, এ বিষয়ের উপর।
আমি হয়তো, হোমওয়ার্ক করছি; কিংবা এসাইনমেন্ট তৈরি করছি; অথচ মন পড়ে রয়েছে ফেসবুকে। “উমুক চ্যাটবক্সে কি হচ্ছে?” “কেউ আমাকে নক করল কি না?” “স্ট্যাটাস টা যে দিলাম, কয়টি লাইক পড়লো?”
এটি তো গেল, একটি কাজ করার মুহুর্তে আমার মনযোগের উপর ফেসবুকের প্রভাব। কিন্তু এমনটাও ঘটে, একইসাথে একাধিক বিষয় আমার মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, যদি এসাইনমেন্ট করার মুহুর্তের কথা চিন্তা করি- ফেসবুক তো গেলই; সেই সাথে আমার চিন্তা হচ্ছে,
“কালকে স্যারকে পাব তো? স্যার যদি কালকে না জমা নেন? পরশুও তো জমা দেয়া যাবে! অযথা আজকে খাটছি কেন?” কিছুক্ষণ পরই বা মনে হচ্ছে, “৫ টা নম্বরের জন্য এতো কষ্ট করার দরকার কি?” আবার সাথে সাথে মনের মধ্যে এটাও ঘুরছে যে, “আমার রাইটিং স্কিল ভাল না। এটা ডেভলাপ করা দরকার।” “ধুর! কিছুই তো পারি না। আমার দ্বারা কিছুই হবে না।” কিছুক্ষণ পরই আবার ভাবছি, “ফেব্রুয়ারি আসতেসে। এইবার বেশ ভাল টাকা জমাইসি। বই কিনে ঘাপায় দিব!” “একটু গান শোনা দরকার!” “আহা! বাংলাদেশ কি ভালই না খেলতেসে। একের পর এক ম্যাচ জিততেই আছে। নেক্সট ম্যাচটা মাঠে গিয়ে দেখা দরকার।”
এইসবের সাথে আরও কত-শত চিন্তা যে মাথায় আসে, বলা মুশকিল। আমরা এইসব ‘আজাইরা’ চিন্তা দূর করতে চাই। এসব জাংক চিন্তা-ভাবনা কি আসলেই দূর করা সম্ভব?
সম্ভব। অবশ্যই সম্ভব।
তার আগে আসুন আমরা একটা সিচুয়েশন কল্পনা করি।
ধরুন, আপনি পড়তে বসবেন। আপনার টেবিল প্রচুর অগোছালো। গতকাল রাতে খাওয়া চা এর কাপ এখনো এখানেই পড়ে রয়েছে। বই-পত্র, খাতা-পত্র, সব এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে আছে। দুই-একটা ম্যাগাজিনও চোখে পড়ে। আবার গতকালের পত্রিকাটিও টেবিলের উপরে। এরকম একটি টেবিলে সাধারণত পড়ায় মন বসানো খুব কঠিন কাজ।
কিন্তু আপনি যদি বিরল প্রজাতির মানুষ হয়ে থাকেন; অর্থাৎ এসব অগোছানোপনায় আপনার কোন বিকার না থাকে, তবে আমি আপনাকে অনুরোধ করব, একটিবারের জন্য আপনি আপনার মা এর কথা ভাবুন। এরকম অগোছালো টেবিল দেখলে আপনার মা আপনাকে কি বকাটাই না দিতেন, সেটি চিন্তা করুন।
এখন আপনি যদি আর সকলের মতোন হয়ে থাকেন, তবে সেই টেবিলে পড়ার পরিবেশ ফিরিয়ে আনার জন্য সবকিছু গুছাতে শুরু করুন; আর আপনি যদি উপরোক্ত বিরল প্রজাতির হয়ে থাকেন, তবে মায়ের বকুনি থেকে বাঁচতে টেবিলটি গুছাতে শুরু করুন।
এই টেবিল গুছানোর মতোই আসলে আপনার ভাবনাগুলো গুছাতে হবে।
অগোছালো ভাবনা গুছানোর একটি চমৎকার প্রক্রিয়া রয়েছে
১. শুরুতে একটি পৃষ্ঠায় আপনার মনের সকল ভাবনা গুলো লিখে ফেলুন। সকল বলতে সকল। যা যা মনের আকাশে ঘুরপাক খাচ্ছে সব। কোন কিছুই বাদ দিবেন না। আপনার ভাবনাক্ষেত্র যদি প্রচুর হয়, একটি পৃষ্ঠায় আটছে না; সমস্যা নেই! আরেকটি পৃষ্ঠা নিন। কিন্তু সকল কিছু লিখে ফেলুন।
২. এবার আরেকটি পৃষ্ঠায় তিনটি ছক আঁকুন। আপনার লিখিত সকল ভাবনার মধ্য থেকে যেগুলো এখন করতে হবে (to be done) সেগুলোকে প্রথম ছকে স্থান দিন। যেগুলো পরে করলেও চলবে (may be later) সেগুলোকে দ্বিতীয় ছকে রাখুন এবং অপ্রয়োজনীয় ভাবনাগুলোকে তৃতীয় বা delete ছকে ফেলুন।
৩. এবার এক মুহুর্ত দেরী না করে তৃতীয় ছকটি আসলেই ডিলিট করে দিন। ঐ অংশটুকু তৎক্ষণাৎ ছিঁড়ে ফেলে দিন ডাস্টবিনে।
৪. আপনার টেবিলের সামনে বা আপনার রুমে বা কোন একখানে (সুবিধামতন) একটি to do list টানিয়ে রাখার স্থান ঠিক করুন। পূর্বে থেকে এমন স্থান থাকলে, সেখানে may be later ভাবনাগুলো টানিয়ে রাখুন। আর এমন স্থান না থাকলে, পরামর্শ থাকবে এখুনি বানিয়ে ফেলুন।
৫. সর্বশেষে যে ভাবনাগুলো প্রথম ছকে স্থান পেয়েছিল, সেগুলোর লিস্ট এমন একখানে টানিয়ে রাখবেন, যেটা সার্বক্ষণিক আপনার চোখে পড়ে।
এই প্রক্রিয়া কি আসলেই কাজে দিবে? দিলে, আসলে কি ভাবে?
এই পুরো প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আপনি প্রাথমিকভাবে যেটা করলেন, সেটা হচ্ছে নিজেকে সময় দেয়া। নিজের ভাবনাগুলোকে সময় দেয়া। আপনার এই কর্মচঞ্চল-ব্যস্ত নাগরিক জীবনে আপনি নিজেকে খুব একটা সময় দেন না। আপনার একান্ত নিজের ভাবনাগুলো আপনার সাথে সময় কাটাতে পারে না। এই ছক করার অযুহাতে আপনি আপনার নিজের সাথে তথা আপনার ভাবনাগুলোর সাথে সময় কাটালেন।
এই প্রক্রিয়ায় দ্বিতীয় যেটা ঘটলো, সেটা আপনার ঐ পড়ার টেবিল গুছানোর মতোন, সকল ভাবনাগুলো একটা অর্গানাইজড শেপ পেল। এতে আপনি অনুধাবন করতে পারবেন, আসলে কোন অপ্রয়োজনীয় বা আকাশ-কুসুম খেয়ালটা আপনার ক্ষতি করছে, আর কোন ভাবনাটা নিয়ে আসলেই আপনার কাজ করা উচিত।
একটি অর্গানাইজড বা রুটিনমাফিক জীবন-যাপন করলে আপনার যেমন উৎপাদনশীলতা বাড়ে; ঠিক তেমনি আপনার ভাবনাগুলোও যদি একটি অর্গানাইজড আকার ধারণ করে, তাহলেও আপনার উৎপাদনশীলতা বাড়বে।
সবশেষে, এই প্রযুক্তির যুগে নিজেকে ট্র্যাকে রাখতে আপনি প্রযুক্তির সহায়তা নিতে পারেন। Pomodoro Challenge নামের এ্যাপটি ব্যবহার করতে পারেন।
Happy mind refreshing…
Happy mind reshaping…
ফিরোজ শরীফ
শিক্ষার্থী, মনোবিজ্ঞান বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
- This author does not have any more posts.