সে আমাকে বুঝি ভালোবাসে না

সবসময়ই মনে হয় সে আমাকে বুঝি ভালোবাসে না

আমার সমস্যাটা একটু অন্য ধরনের। আমার জীবনের কোটি কোটি সমস্যা, আমার হাজার হাজার কষ্টের মধ্যে এটা একটা, তবে এই মুহূর্তে এই চিন্তাটিই আমাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। আমি নিজেকে সবসময়ই ভীষণ আত্মমর্যাদাসম্পন্ন একজন মানুষ হিসেবেই জেনে এসেছিলাম। জীবনে কোনোক্ষেত্রেই খুব বেশি rejection এর সম্মুখীন হতে হয়নি, তবে কখনো যদি বুঝি কারো কাছে আমার মূল্য কম, কারো কাছে আমার সান্নিধ্য খুব একটা প্রার্থনীয় নয়, নিঃশব্দে তাদের কাছ থেকে নিজেকে সরিয়ে এনেছি। কখনোই কারো কাছে কোনো অনুগ্রহ প্রার্থনা করিনি, যেচে পড়ে কারো সাথে সম্পর্ক রাখিনি, কারণ এতে আমার নিজেকে খুব ছোট মনে হয়।

আমি যাকে বিয়ে করেছি, সবসময়ই মনে হয় সে আমাকে বুঝি ভালোবাসে না। যেহেতু আমাদের arrange marriage, আমার মনে হয় সে পরিবারের চাপে পড়ে আমাকে বাধ্য হয়ে বিয়ে করেছে, কোনো ভালবাসা থেকে নয়। আমার বর আমার খেয়াল রাখে না তা নয়, কিন্তু তার বেশ কিছু আচরণ আমার কাছে খুব শীতল মনে হয়। তার কাছে এসবের উত্তর চাইলে সে সবসময় এড়িয়ে যাবে বা কোনো যুক্তি দেখাবে, কিন্তু এখন আমি এসবে আর convinced নই। তবে সম্পর্ক ভেংগে দেয়ার মত মানসিক শক্তিও আমার নেই। আমি emotionally তার উপর বেশ নির্ভরশীল (depended)। সারাক্ষণ মাথার মধ্যে তার কথাই, তার চিন্তাভাবনাই ঘুরতে থাকে।

আমি নিজের গভীর আবেগগুলো সাধারণত তেমন কারো কাছে প্রকাশ করিনা, কিন্তু যেহেতু আমি তাকে ভালবেসেছিলাম, তাকে বিয়ে করেছি, আমি তার কাছে আমার আবেগ প্রকাশ করেছিলাম। অতীতেও সে আমার সাথে শীতল আচরণ করা সত্ত্বেও আমি তার সাথে সম্পর্ক চালিয়ে গেছি, যে মানুষ সবকিছু থেকেও আত্মসম্মানবোধকে সবচেয়ে গুরুত্ব দেয়, শুধু তার জন্য আমি সম্পর্কটিকে ভালো রাখার জন্য অনেক সময় নিজের অহংবোধকে বিসর্জন দিয়েছি। তাই সম্ভবত সে আরও বেশি অসম্মানজনক আচরণ করার সাহস পেয়েছে আমার সাথে। এসব ভেবেই ক্ষমা করতে পারি না নিজেকে, সারাক্ষণ মাথায় এসব চিন্তা চলতে থাকে। মনে হয় অতীতের ঘটনাগুলোতে আমি কী করতে পারতাম, কী করা উচিত ছিল। একদম obsession এর মত বিরামহীন এসব চিন্তা আমার মাথায় ঘোরে।

আমার প্রশ্ন দুটি-
১) আমি অতীতকে পরিবর্তন করতে পারব না, কিন্তু নিজেকে কীভাবে ক্ষমা করতে পারি? এসব obsessive thought থেকে কিভাবে মুক্তি পাবো?


২) কিভাবে আমার বরের ওপর থেকে নিজের emotional dependency কমিয়ে নিয়ে আসবো? আমার আবেগগুলো প্রকাশের কোনো বিশ্বস্ত (trustworthy) মানুষ নেই, আমি আবেগের প্রকাশ নিয়ন্ত্রণ করতে চাই।

খুব অসহনীয় লাগছে সবকিছু। আমার সাহায্যের খুব বেশি প্রয়োজন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক

আমাদের পরামর্শ

আপনার লেখা কথাগুলো বেশ কয়েকবার পড়লাম। খুব গুছিয়ে জীবন্ত করে লিখতে পারেন আপনি!

আপনাদের বিয়ের বয়স কতদিন তা উল্লেখ করেননি, কিন্তু অনুমান করছি, সম্পর্কটা নতুন। আপনার ধারণা, আপনার স্বামী আপনাকে ভালোবেসে নয়, পরিবারের চাপে বিয়ে করেছে। আপনার স্বামী “শীতল আচরণ” করছে। ইদানিং হয়ত এমন কিছু করেছে, যা আপনার জন্য সাঙ্ঘাতিক “অসম্মানজনক”। বরের এই “শীতল” আর “অসম্মানজনক” আচরণ ভীষণ আত্মমর্যাদাবোধ সম্পন্ন আপনার ব্যক্তিত্বকে এমনভাবে আঘাত করছে, যাতে আপনার মাঝে মাঝে সম্পর্ক ছিন্ন করার কথাও মাথায় আসছে। নিজেকেও দোষারোপ করছেন। আবার সেই মানুষটার ওপর আপনি ইমোশোনালী নির্ভরশীল হয়ে পরেছেন।    

আপনার লেখায় কিছু বিষয় লক্ষ্য করা যায়।

১)  আপনাকে “জীবনে কোনোক্ষেত্রেই খুব বেশি প্রত্যাখান (rejection) এর সম্মুখীন হতে হয়নি” ফলে আপনি নিজেকে “সবসময়ই ভীষণ আত্মমর্যাদাসম্পন্ন” মানুষ হিসেবে জেনে এসেছেন। আবার বলেছেন, “আমার জীবনের কোটি কোটি সমস্যা, আমার হাজার হাজার কস্ট”। এই দুইটি উপলব্ধি সাংঘর্ষিক লাগছে।

২) আপনার বর অনেক “শীতল” আচরণ করে যা আপনাকে কষ্ট দিচ্ছে। তিনি আপনার আবেগীয় চাহিদা পূরণ করতে ব্যর্থ হচ্ছেন। এই “শীতল” আচরণ আসলে কি সেটা পরিষ্কার হওয়া দরকার। আপনার বরের মাথায় “উঞ্চ/শীতল” আচরণের এই ধারণাগুলো আছে কিনা, তাও জানা দরকার। যদি তিনি জেনে-শুনে শীতল আচরণ করে যান, তাহলে এক কথা। আর না জানলে আরেক কথা। ভালোবাসা, সুখ, রোমান্সের সাথে জড়িত কনসেপ্টগুলো খুবই “বিমূর্ত” এবং জাতি, ধর্ম, বর্ন, লিঙ্গভেদে একেবারেই অভিন্ন নয়।      

৩) “শীতল” আচরণ করা সত্বেও আপনি তাকে ভালোবেসেছেন, মনের কথা বলেছেন। ফলে একটা আবেগীয় নির্ভরতার জায়গা তৈরি হয়েছে। নিজের আবেগ প্রকাশ করে আপনি যতটা গুরুত্ব ও ভালবাসা আপনার বরের কাছে আশা করেছেন ততটা পাচ্ছেন না। ফলে অনেক কষ্টকর অনুভূতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। তাই আবেগ প্রকাশের জন্য নিজেকেই দোষী ভাবছেন আর বরের সাথে দূরত্ব বজায় রাখতে চাইছেন। আবার আপনি এই সম্পর্ক থেকে বেড়িয়ে আসতেও চাইছেন না।

৪) আপনার প্রশ্নদুটো থেকে বোঝা যাচ্ছে, এই মুহূর্তে দাম্পত্য ইস্যু নিয়েই আপনি প্রায় দিনের পুরোটা সময় অতিবাহিত করছেন। একটা না একটা বিহিত করেই কেবল ক্ষান্ত হবেন, অন্তত মনে মনে তাই ভাবছেন।

সর্বপরি, আপনার লেখা থেকে আপনাকে আত্মপ্রত্যয়ী, দৃঢ় আত্মমর্যাদাবোধ সম্পন্ন একজন মানুষ বলে মনে হয়েছে, যার জীবন গল্পের (Life Narrative) সাথে হয়তবা সাঙ্ঘাতিক পছন্দের মানুষটির জীবন গল্পের ছন্দ মিলতে অসুবিধা হচ্ছে। এই ছন্দ মিলাতে হলে দু’জনকে খোলামন নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। খোলামন মানে পূর্বধারনা, বিচারবিশ্লেষণ, অনুমান আর সরলীকরণ পেছনে রাখা। ফলপ্রসূ ফলাফলের জন্য হয়ত কিছুটা ধৈর্যও ধরতে হবে।     

ক্যারিয়ার, পড়ালেখা, শখ ইত্যাদি নিয়ে কিছু লিখেননি। আপনার জীবনের এই স্তরে (Life stage) “সম্পর্ক” হয়ত প্রধান বিষয়, কিন্তু একজন ব্যক্তি হিসেবে তার পরিচয় তো আর শুধু সম্পর্ক দিয়েই পরিপূর্ণ হয় না। জীবনের অন্য বিষয়গুলো যেন একেবারেই অবহেলিত না থাকে, সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে।  

আপনি বলেছেন আপনি একসাথে অনেকগুলো সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। যেহেতু আমাদের জীবনের সমস্যাগুলো একটার সাথে আরেকটা ভীষণভাবে যুক্ত, তাই আপনি সরাসরি কাউন্সেলিং সেবা নিয়ে একে একে সমস্যাগুলো নিয়ে গভীরভাবে কাজ করতে পারেন।


মনে রাখা ভাল- আবেগপ্রবণ হওয়া বা আবেগ প্রকাশ করা দোষের কিছু নয়। বরং এসব না  ঘটাই অস্বাভাবিক। কিন্তু কিভাবে আবেগ প্রকাশ করে সুস্থ-সুন্দর জীবনযাপন করতে পারি তা শেখার বিষয়।

আপনার জন্য ভালবাসা ও শুভকামনা।

 

রাউফুন নাহার
+ posts

রাউফুন নাহার মাস্টার্স করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশনাল অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগ থেকে এবং অনার্স করেছেন একই বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগ থেকে। বর্তমানে এডুকেশনাল এন্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগে প্রভাষক হিসেবে কর্মরত আছেন। ভালোবাসেন মানুষ, প্রকৃতি আর তাদের ভেতরের অন্তর্নিহিত সুরকে।

Post Author: রাউফুন নাহার

রাউফুন নাহার মাস্টার্স করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশনাল অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগ থেকে এবং অনার্স করেছেন একই বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগ থেকে। বর্তমানে এডুকেশনাল এন্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগে প্রভাষক হিসেবে কর্মরত আছেন। ভালোবাসেন মানুষ, প্রকৃতি আর তাদের ভেতরের অন্তর্নিহিত সুরকে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।