শিশু ভাষা

খেলা- শৈশবে শিশুর ভাষা

জারা এবং জারিফ দুই ভাইবোন। খুব দুষ্টমি করছে, বাবাকে ব্যবসার জরুরি কাজে বিরক্ত করছে। এদিকে মা গেছেন বড়বোনের স্কুলে। বাবা তাদের শান্ত করার জন্য হাতে দিলেন  আইপ্যাড। বিষয়টা এমন যে আমিও খুশি তুমিও খুশি।

এটা একটা সাধারণ চিত্র।

এবার আপনাকে play অথবা খেলা শব্দটি নিয়ে কয়েক সেকেন্ড চিন্তা করতে বলছি। চোখ বন্ধ করলে খেলা নিয়ে আপনার মাথায় কোন শব্দ বা ছবিটি ভেসে আসছে? আমার কথাই বলি। আমি যখন প্রথম এই অনুশীলন করি, আমার মনে পড়েছিল পাবনা জেলার আটঘরিয়ার উপজেলার কলোনির কথা। বাবার সরকারি চাকুরির সুবাদে আমার শৈশব কেটেছে ওখানে। অপেক্ষায় থাকতাম কখন আছরের আযান দিবে। আযান হলেই দৌড় দিতাম খেলার মাঠে- বউচি, কানা মাছি, বরফপানি আর কত কিছু খেলতাম!

আচ্ছা, আজকের শিশুরা যখন বড় হবে, তাদের একই প্রশ্ন করলে কী উত্তর আসতে পারে? উপরের উদাহরণের মত আজকের শিশুরা হয়তো প্লে বলতে ভিডিও গেম কিংবা ট্যাব বা আই প্যাডে খেলেছে এরকম কোন গেম এর কথা বলবে!

খেলা শৈশবের একটি মৌলিক কর্মকান্ড যা শিশু স্বতঃস্ফূর্তভাবে, আনন্দের সাথে এবং সেচ্ছায় করে থাকে। খেলাকে বলা হয় শৈশব কালের শিশুর ভাষা। জাতিসংঘ খেলাকে শৈশবের সার্বজনীন অধিকার হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। আমার এই লেখার উদ্দেশ্য খেলার গুরত্ব নিয়ে কিছু তথ্য তুলে ধরা।

মনোবিজ্ঞানী নিকেরসন (১৯৭৩) এর মতে খেলা হলো একটা শিশুর আত্মপ্রকাশ, পরীক্ষণ এবং শিক্ষণের প্রাকৃতিক মাধ্যম। খেলার মাধ্যমে শিশুর মস্তিস্কের বিকাশ হয় যা শিশুর কল্পনাশক্তি, সৃজনশীলতা, সমস্যা সমাধান, সামাজিক যোগাযোগ বা ভাষার দক্ষতা, সূক্ষ্ম ও স্থুল পেশীর দক্ষতা বৃদ্ধি করে।

জন্মের পর  অভিভাবকের হাসিমুখ, উষ্ণ আলিঙ্গন শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশে সহায়তা করে। ছোট্ট শিশু যদি খেলার মাধ্যমে অনুভব করে অভিভাবক কিংবা সেবা প্রদানকারীর সাথে ভালবাসার সম্পর্কের  মাধ্যমে সে সুরক্ষিত, তাহলে সে শিশুর বুদ্ধিমত্তার বিকাশ সঠিক ভাবে ঘটবে। অপরদিকে শিশুর সাথে অভিভাবকের সম্পর্কটা যদি নিবিড় এবং সুরক্ষিত না হয় তাহলে তা তার শারীরিক ও আবেগীয় বিকাশে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। যেমন শিশুর আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি দেখা দিতে পারে, ঝুকিপূর্ণ আচরণে লিপ্ত হতে পারে, হীনমন্যতায় ভুগতে পারে, নিজের ক্ষতি করার প্রবণতা দেখা দিতে পারে। এমনকি এসব শিশুরা পরবর্তীতে অন্যের সাথে মেলামেশাতেও অসুবিধার সম্মুখীন হয়।

একটি সুখি এবং প্রাঞ্জল মস্তিস্কের অধিকারি শিশুর চিন্তাশক্তি প্রখর এবং সুখী জীবন যাপনের জন্য দক্ষ হয়ে থাকে। আর সেটা সম্ভব হয় শিশুর নির্মল এবং আনন্দময় খেলার মাধ্যমে। খেলার মাধ্যমে শিশুর এই বাড়ন্ত মস্তিস্কের সঠিক বিকাশ কিংবা মস্তিষ্কের ক্ষতিগ্রস্থ কোন কোষের নিরাময়ের জন্য অভিভাবক কিংবা সেবা প্রদানকারীর  তিনটি বিষয় খেয়াল রাখা জরুরি।

এক. সহমর্মিতা

সহমর্মিতা প্রকাশ করতে হলে শিশুর অনুভুতি এবং ইচ্ছাকে সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করা জরুরি। যেমন, তুমি আনন্দিত, খেলায় জিতেছ! এছাড়াও, আমি শুনছি… ,আমি তোমার সাথে আছি…,আমি এখানে আছি…,আমি বুঝতে পারি… এরকম বাক্যের ব্যবহার শিশুর প্রতি আপনার সমানুভুতি প্রকাশ করবে। শিশুর ইচ্ছাকে চিহ্নিত করার জন্য বলতে পারেন, তুমি যে খেলনা কিনতে চাইছ সে খেলনা কিনতে পারনাই।  

শিশুর জ্ঞান ও বিশ্বাসকে স্বীকৃতি দিতে হবে। যেমন বলা যেতে পারে, ‘বাহ! তুমি এই খেলার সকল নিয়ম জানো!’

দুই. নিঃশর্তভাবে গ্রহণ করা

শিশু যদি বুঝতে পারে সে যা সে হিসাবেই আপনি তাকে গ্রহণ করেছেন তাহলে এটাই হবে আপনার দেয়া শিশুকে সবচেয়ে শক্তিশালী বার্তা।   

তিন. সামঞ্জস্যতা

শিশুর মধ্যে সততা, বিশ্বাসযোগ্যতা গুণগুলো তৈরি করার সবচেয়ে সহজ উপায় হলো তাদের সামনে সেগুলো করে দেখানো। অর্থাৎ আপনি মুখে যা বলছেন কাজেও তা করে দেখাচ্ছেন। হাজারটা উপদেশবাণির চেয়ে আপনার একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ আচরণ শিশুর মধ্যে অনেক পরিবর্তন আনবে। ধরুন, আপনি চাইছেন শিশু সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠুক। সে কাজটা আগে আপনি শুরু করে দিন, শিশু এমনিতেই শিখে যাবে। কেননা, অনুকরণের মাধ্যমে শিশুরা অনেক বেশি কিছু শিখে।

পরিপূর্ণ এবং সুস্থ বিকাশের জন্য শিশুর আবাসে খেলা উপযোগী পরিবেশ গড়ে তোলাই হোক আপনার অন্যতম লক্ষ্য।   

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সাবরিনা মাহমুদ
সিনিয়র ডেমোন্সট্রেটর at ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় | + posts

এডুকেশনাল সাইকোলজিস্ট
সিনিয়র ডেমোন্সট্রেটর
এডুকেশনাল এন্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Post Author: সাবরিনা মাহমুদ

এডুকেশনাল সাইকোলজিস্ট সিনিয়র ডেমোন্সট্রেটর এডুকেশনাল এন্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।