তোতলামির কারণে ছোটকাল থেকে হীনম্মন্যতায় ভুগছি

তোতলামির কারণে ছোটকাল থেকে হীনম্মন্যতায় ভুগছি

আমি মাস্টার্সে পড়ছি, পাশাপাশি জব করি। অনেকদিন ধরে লক্ষ্য করছি কোনো একটি কাজ অথবা পড়ার সময় হঠাৎ অন্যমনস্ক হয়ে যাই। মনোযোগ দীর্ঘক্ষণ ধরে রাখতে পারি না। কেউ ধমক দিলে বা ব্যতিক্রম কিছু বললে সহজে ভয় পেয়ে যাই, তখন বুক ধরে যায় এবং নার্ভাস হয়ে পড়ি। পরে চিন্তা করি, কেন সামান্য কথায় আমি ভয় পাই। আমার কি ওইটুকু সাহস নেই? কেন ওসব কথার উচিৎ জবাব দিতে পারি নাই? এসব ভেবে কষ্ট পাই এবং ঐ ব্যক্তির প্রতি ক্ষোভ জন্মে। এছাড়া আমার তোতলামি সমস্যা আছে। কেউ আমাকে একটু হেও করে কথা বললে, খারাপ ব্যবহার করলে আমি রেগে যাই।

বড় একটা সমস্যা হচ্ছে, এক বছর আগে আমার চার বছরের প্রেমের সম্পর্কের ব্রেকআপ হয়। মেয়েটি আমাকে বিনা কারণে ধোঁকা দিয়ে কৌশলে অন্য এক ছেলের সাথে সম্পর্কে জড়ায়। তা আমি কিছুতেই মানতে পারি নাই। ওই সময় মেয়ে পক্ষের লোক আমার সাথে অনেক খারাপ ব্যবহার করে এবং হুমকি দেয় যা আমার মনে ক্ষোভ এবং প্রতিশোধের জন্ম দেয়। ভুলতে চাইলে খারাপ সময় গুলো মনে পড়ে, আর কাজের ফাঁকে ওগুলোর মাঝে হারিয়ে যাই। অনেক সময় ইচ্ছে হয় অপমানের প্রতিশোধ নিতে, আবার আনমনে ইচ্ছে হয় পুরোনো সম্পর্কে ফিরে যেতে। যেকোনো কাজে, যেকোনো ঘটনায় পুরোনো প্রেমিকার কথা মনে পরে যায় আর আমি ভাবনায় হারিয়ে যাই। 

আমি তাকে সম্পূর্নভাবে ভুলে সুন্দর ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যেতে চাই। কিন্তু আবেগ, স্মৃতি আমাকে সর্বদা ঘিরে রাখে। আমি সেসব ভাবতে থাকি। যেন জোর করে অবচেতন মন আমাকে ভাবায়, কেনো এমন হলো, এমন হলে কেমন হতো, ওইটা বললাম না কেন, ইত্যাদি ইত্যাদি। যতসব অর্থহীন ভাবনা।

এছাড়া আমার তোতলামি সমস্যা আছে, মনের ভাষা সুন্দরভাবে ব্যক্ত করতে পারি না বলে ছোটকাল থেকে হীনম্মন্যতায় ভুগছি। এটা আমার সাফল্যের পথে বড় বাঁধা মনে হয়। এই তোতলামি আমার আত্মবিশ্বাসকে দুর্বল করে দেয়। নিজেকে অসম্পূর্ণ মনে হয়। অনেকের কাছে হাসির পাত্র হই আর নীরবে কষ্ট ভোগ করি। যেকোনো মূল্যে আমি তোতলামির প্রতিকার চাই। এটা মানসিক দুশ্চিন্তার অন্যতম কারণ বলে আমি মনে করি।

আশা করি আপনাদের সু-পরামর্শ আমার অনেক উপকার হবে। আমি সমস্যাগুলোর স্থায়ী সমাধান চাই, স্যার। আপনার জন্য শুভ কামনা রইল। ধন্যবাদ।

আমাদের পরামর্শ

প্রথমেই আপনাকে ধন্যবাদ জানাই প্রশ্নটি সুন্দরভাবে গুছিয়ে উপস্থাপন করবার জন্য। আপনার লেখনীতে অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যতের দিকগুলো উঠে এসেছে। আপনি একইসাথে পড়াশোনা এবং চাকরি করছেন যা আপনার ব্যক্তিত্বের একটি ইতিবাচক দিক। এটা একইসাথে একজন পরিশ্রমী মানুষের গুনকেও ইঙ্গিত করছে। আপনি নিজেকে আরও আত্মবিশ্বাসী দেখতে চান, যাতে বোঝা যায় আপনি নিজেকে সুযোগ দিতে আগ্রহী। নিজেকে সুযোগ দেয়ার দিকটি ইতিবাচক। আপনার এই আগ্রহকে আমি প্রশংসা করি  এবং শ্রদ্ধা জানাই।

আপনার লেখা থেকে বোঝা যাচ্ছে, নিজের প্রতি আপনার বিশ্বাস অনেক কম। বর্তমানে আপনি অন্য যেসকল অসুবিধায় পড়ছেন তার মূল কারণ হয়ত এই দুর্বল আত্মবিশ্বাস। আর দুর্বল আত্মবিশ্বাসের পেছনে আছে, আপনি কি চান বা বলতে চান তা সঠিকভাবে, সঠিকসময়ে প্রকাশ করতে না পারা। আপনার কথায়, তোতলামির জন্য ঠিকভাবে গুছিয়ে মনের ভাব প্রকাশ করতে পারেন না, সেই ছোটকাল থেকেই। বর্তমানে যখন চার বছরের পুরোনো সম্পর্ক ভেঙ্গে গেল, নিজের অজান্তের ঘুরে ফিরে নিজের দুর্বলতা আর অক্ষমতাই আপনার মনে চলে আসছে। আপনি প্রাণপণ চেষ্টা করছেন, সেসব নিয়ে চিন্তা না করতে, কিন্ত সফল হতে পারছেন না। বারবার ঐ একই চিন্তায় ডুবে যাচ্ছেন। ফলে বর্তমানে আপনার জরুরি কাজগুলো ভালোভাবে করতে পারছেন না। এই খারাপ পারফরমেন্স আবার আত্মবিশ্বাস দুর্বল করে দিচ্ছে। এ যেন দারিদ্রের দুষ্টচক্রের মতো অবস্থা। 

কী করবেন এখন? 

আপনার চিঠিতে উল্লেখিত বিষয়াদি পর্যালোচনা করে, তিনটি ধাপে আমার পরামর্শ উপস্থাপন করছি। 

প্রথম ধাপঃ আত্মবিশ্লেষণ 

এই ধাপে আপনি নিজের সাথে নিজের দেন দরবার করে কিছু প্রশ্নের উত্তর বের করতে পারেন। যেমন, (ক) নিজেকে নিয়ে আপনি যে ছবিটা এঁকেছেন তা কী সঠিক? “নিজেকে অসম্পূর্ণ মনে হয়” “অনেকের কাছে হাসির পাত্র হই” এই ধারণাগুলো আসলেই সত্য নাকি আপনার নিজের বিবেচনা। আমাদের সকল বিবেচনা সঠিক হয় না। তাই এসবও সঠিক নাও হতে পারে।   

(খ) আপনার সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো নিয়ে যে সমীকরণ টেনেছেন তা-ও কি শতভাগ সত্য? যেমন, মেয়েটি আপনাকে “বিনা কারণে” ধোঁকা দিয়েছে বলে যে ধারণা, সেটা একান্তই আপনার নিজের মূল্যায়ন। মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করলে হয়ত কিছু কারণ পাওয়া যাবে। আর যদি কোনো যৌক্তিক কারণ নাও থাকে, একজন প্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তি হিসেবে প্রেম ভালোবাসা বা বিয়ে নিয়ে যেকোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার (যেমন, সম্পর্ক বিচ্ছেদ) অধিকার তিনি রাখেন। সেক্ষেত্রে আপনি সম্পর্ক বিচ্ছেদের কষ্ট পাচ্ছেন। কিন্তু ‘সম্পর্ক গড়া আর বিচ্ছেদ’ জীবনের অপর নাম নয়। একবার সম্পর্ক ভেঙ্গে গেলে, জীবন শেষ হয়ে গেল, এটা ভাবার অবকাশ নেই। সম্পর্ক গড়া একটা নির্দিষ্ট বয়সের (১৫-৩০ বছর) বিকাশজনিত চাহিদা (Developmental Need) ।  

দ্বিতীয় ধাপঃ অ্যাকশন 

আত্মবিশ্লেষণ করে নতুন কিছু উপলব্ধি হলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়াটাই অ্যাকশন। (ক) তোতলামির কোনো বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসা আছে কিনা? থাকলে সেটা কিভাবে পেতে পারেন। তোতলামি আপনার জন্মগত কীনা তা উল্লেখ করেন নি। যদি জন্মগত হয় তবে Speech & Language Therapist (SLT) এর সহযোগিতা নিতে পারেন।  আর যদি তোতলামি বিশেষ চাপমূলক পরিস্থিতিতে (Stressful Situation) বেশি অনুভূত হয়, তবে তা মানসিক অস্থিরতার (Over Anxiousness) কারণে হচ্ছে বলে অনুমেয়। সেক্ষেত্রে একজন পেশাজীবি মনোবিজ্ঞানীর সহযোগিতা নেয়ার প্রয়োজন আছে। পেশাজীবি মনোবিজ্ঞানী হতে পারেন একজন ক্লিনিক্যাল/ কাউন্সেলিং/এডুকেশনাল সাইকোলজিস্ট যিনি একটি কাঠামোবদ্ধ প্রক্রিয়ায় আপনার উল্লেখিত বিষয়গুলোকে অর্থপূর্ণ ব্যাখ্যা এবং বিজ্ঞানসস্মত কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করে সমস্যা থেকে উত্তরণ করতে সহায়তা করতে পারেন। এতে আপনার সমস্যার স্থায়ী সমাধানের পথ তরান্বিত হবে বলে আশা করা যায়। 

খ) অন্যের অধিকার খর্ব না করে নিজের অধিকার আদায় করাকে এসারটিভনেস বলা হয়ে থাকে। এসারটিভ কথাবার্তার ধরনকে বলা হয়ে থাকে “অহিংস যোগাযোগ”। এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি দক্ষতা যেটাতে উন্নতি করলে আপনার অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। এসব বিষয়ে জানতে এবং কীভাবে নিজের মধ্যে এসারটভনেস এবং অহিংস যোগাযোগ বাড়াবেন, তার কৌশল জানতে এই লেখাটি পড়ুন। (আরো পড়তে পারেন এই বইটি)। সম্পর্ক ভেঙ্গে যাওয়া এবং এর সাথে ঘটনাগুলো আপনার জন্য কষ্টকর এবং অপমানজনক। পুরো বিষয়টিকে পুনরায় বিশ্লেষণ করে দেখতে পারেন, কোন জায়গাগুলো আপনি ভিন্নভাবে আপনার মতামত ব্যক্ত করতে পারতেন। ভেবে দেখুন, সেই ঘটনা থেকে কী কী অভিজ্ঞতা পরবর্তীতে একইরকম পরিস্থিতি মোকাবিলায় আপনাকে সহায়তা করতে পারে। ব্যর্থতাকে দূর্বলতা হিসেবে না ভেবে আত্মিক উন্নয়ন বা পারদর্শিতা বাড়ানোর ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচনা করা যায় যা একজনকে ইতিবাচক এবং আত্মবিশাসী মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে সহায়তা করে। 

তৃতীয় ধাপঃ এক্সসেপ্টেন্স 

অর্থাৎ নিজে আপনি যেমন তেমনভাবেই নিজেকে গ্রহণ করা। যত দ্রুত সেটা করতে পারবেন তত তাড়াতাড়িই ভালো বোধ করা শুরু করবেন। চেহারা, দক্ষতা, সম্পর্ক ভেঙ্গে যাওয়ার কষ্ট সবই আপনার। তাই কোনো চিন্তা বা মানুষকে সম্পূর্ন ভুলে যেতে চাইলেও পারবেন না, এসব নিয়েই আপনি সম্পূর্ন, ১০০ তে ১০০। আপনার জন্য শুভকামনা। 

Masuma Akter Sumi
মাসুমা আকতার সুমি
+ posts

এসিস্ট্যান্ট কাউন্সেলিং সাইকোলজিস্ট। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাইকোলজিতে স্নাতক এবং কাউন্সেলিং সাইকোলজিতে স্নাতকোত্তর করে এখন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে স্টুডেন্ট কাউন্সেলর হিসেবে কাজ করছি।

Post Author: মাসুমা আকতার সুমি

এসিস্ট্যান্ট কাউন্সেলিং সাইকোলজিস্ট। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাইকোলজিতে স্নাতক এবং কাউন্সেলিং সাইকোলজিতে স্নাতকোত্তর করে এখন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে স্টুডেন্ট কাউন্সেলর হিসেবে কাজ করছি।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।